৭ মাসে ৭৩ খুন, নারায়ণগঞ্জে বেড়েছে অপরাধ

প্রকাশিত

বিশেষ প্রতিনিধি:
একের পর এক লোহমর্ষক খুনের ঘটনা ঘটছে নারায়ণগঞ্জে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। রাজধানী লাগোয়া এই গুরুত্বপূর্ণ জেলাটিতে গত ৭ মাসে ঘটেছে ৭৩টি খুনের ঘটনা। সেই সঙ্গে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটছে।


পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, গত আগস্ট মাস থেকে চলতি মাস পর্যন্ত সর্বমোট ৭৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ৫২টি চুরি, ১৩টি ডাকাতি, ৩১টি ছিনতাই এবং ২৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি মাসেই ইতোমধ্যে ১৩টি খুন, ১২টি চুরি, একটি ডাকাতি, ৩টি ছিনতাই বাদেও একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তবে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় কোনো মামলা করেন না।


এর ফলে পুলিশের হিসেবের চেয়ে বাস্তবে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা আরো বেশি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নগরবাসী বলছে, রাতে পুলিশ এবং র‌্যাবের টহল বৃদ্ধি না করা হলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা কোনোভাবেই কমানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির মুখোমুখির করারও দাবি সবার।

শহরের আলোচিত কয়েকটি ছিনতাইয়ের স্পট

কয়েক মাস ধরে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে অনেকেরই সর্বস্ব লুট হচ্ছে। ইতোমধ্যে শহরের কয়েকটি স্পট ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে শহরের চাষাঢ়া, উকিলপাড়া মোড়, নয়ামাটির হোসিয়ারী পল্লীর করিম মার্কেট, মাসদাইরের বোয়ালিয়া খাল, জামতলা, ইসদাইর অক্টো অফিসের সামনে চাষাঢ়া-পঞ্চবটি সড়ক, দেওভোগ পানির ট্যাংকির মোড়, জিমখানা রেলওয়ে কলোনি সংলগ্ন জল্লারপাড় পার্ক এবং শীতলক্ষ্যা নদী তীরের ওয়াকওয়েগুলোতে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া চাষাঢ়া থেকে দুই নং রেল গেট, ও চাষাঢ়া থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত ঢাকা নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক এবং ফতুল্লার কাশিপুর এলাকায় প্রায় প্রতিদিন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই খুন

গত ২৫ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের চেঙ্গাকান্দি এলাকায় প্রাইভেটকার ছিনতাই করতে বাধা দেওয়ায় মো. হানিফ (৬০) নামের এক চালককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

জানা যায়, ২৪ অক্টোবর রাতে তিনি এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রী নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। কিন্তু এরপর তাকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন মহাসড়কের পাশে তার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

অপরাধীদের অভয়ারণ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

একাধিক বড় বড় ডাকাতির ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যানবাহন চালক ও যাত্রীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। পূর্বেও কমবেশি এই মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও সাম্প্রতিক এইসব ঘটনা বেশি ঘটছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে সানারপাড়, কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম অংশ, বন্দরের মালিবাগ, মদনপুর ও কেওঢালা, দড়িকান্দী, টিপরদী, সাদীপুর, মোগড়াপাড়া, আষাড়িয়ারচর ও মেঘনাঘাট টোলপ্লাজা এলাকাগুলো ডাকাতির হটস্পট হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে গত ১৪ জানুয়ারি দুই দুবাই প্রবাসী আবু হানি (৩৫) এবং রাজিব ভূঁইয়া (৩৫) গুলিস্তানের বাইতুল মোকাররম মার্কেট থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বন্দরের কেওঢালা এলাকায় ডাকাতির কবলে পড়েন।

গত ৮ ডিসেম্বর সোনারগাঁয়ের মেঘনা টোলপ্লাজা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব আরিফ সোহেলসহ নেতাদের বহনকারী একটি গাড়িতে ডাকাত দল আক্রমণ করে। এসময় নেতাদের মারধর করে মালামাল লুটে নেয়।

অস্ত্র ঠেকিয়ে ঘটছে অপরাধের ঘটনা


গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জে সোনারগাঁও থানা ও বন্দর থানার মধ্যবর্তী স্থানে মো. আরিফ নামের এক ট্রাক চালককে অস্ত্র ঠেকিয়ে রডভর্তি ট্রাক ডাকাতি হয়। আহত চালক আরিফ জানান, ৪ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ ওয়্যারহাউজ থেকে সাড়ে ৫ টন রড নিয়ে গাজীপুর কোনাবাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হন। ভোর ৫ টার দিকে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের দেওয়ানবাগ এলাকায় পৌঁছালে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল ট্রাকটি গতিরোধ করে। পরে তাকে মারধর করে এক পর্যায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিয়ে রডভর্তি ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে উদ্দেশ্যে চলে যায়।

গত ২৭ নভেম্বর ফতুল্লার সস্তাপুরের গাবতলা মোড় এলাকায় শিল্পপতি রেজাউল করিম মালার বাড়িতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এদিন একদল ডাকাত জানালার গ্রিল কেটে বাসায় প্রবেশ করেন। পরে তারা ওই শিল্পপতির ছেলে ও ছেলের বৌয়ের হাত পা বেঁধে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৭লাখ টাকা ও ৪০ ভরি স্বর্নালংকার লুটে নেয়। ডাকাতরা যাওয়ার সময় দুটি গুলি রেখে যান তাদের ভয় দেখানোর জন্য।

কথায় কথায় পিস্তল উঁচিয়ে গুলি

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় জমি নিয়ে বিরোধে এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখান। পিস্তলের গুলিতে একজন আহত হন বলেও দাবি করা হয়। পরে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

গত ২৮ জানুয়ারি রূপগঞ্জের সাওঘাট এলাকায় একটি পাইকারী আড়তের দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় গুলিবর্ষণ ও ১১ টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ বাড়ি এবং অফিস ভাঙচুর করা হয়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ৬ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২৫ জন আহত হোন। পরে আহতদের ঢাকা মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

পুলিশের উপর হামলা

গত ২৮ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরের জিমখানা রেলওয়ে কলোনীতে পুলিশের উপর হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এদিন রাতে জিমখানা রেলওয়ে কলোনীর ভেতরে ও পরবর্তীতে মন্ডলপাড়া ব্রিজের উপর কয়েক দফা পুলিশের গাড়িতে দেশীয় অস্ত্রসহ হামলা চালায় মাদক ব্যবসায়ীরা। এসময় অন্তত ৫ পুলিশ সদস্য আহত হোন।

নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদী বলেন, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অপরাধীরা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড সংগঠিত করে থাকেন। আমরা এসব বিষয়ে সচেতন রয়েছি। এরই মধ্যে রাতের বেলা আমাদের টহল বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটা মাত্রই আমরা দোষী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। পাশাপাশি অপারেশন ডেভিল হান্টসহ অন্যান্য অভিযান জোরদার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর রয়েছি।

আপনার মতামত জানান