সোনারগাঁ পৌরসভায় অতিদরিদ্রদের চাল নিয়ে চালবাজী
দুস্থ ও অতিদরিদ্রদের জন্য ঈদ উপলক্ষে বরাদ্ধ দেওয়া ভিজিএফের (দুস্থদের খাদ্য সহায়তা প্রকল্প) চাল নিয়ে চলছে নানা ফন্দিফিকির। উপকারভোগীর তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত হরেক চাতুরীর ঘটনা ঘটছে। উপকারভোগী নির্বাচনে মানা হয়নি ৭০ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্তির নিয়ম। সোনারগাঁ পৌরসভায় মেয়র না থাকায় ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও বিভক্তির সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ ব্যাপাওে অনেক নেতাকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
জানা যায়, সারা দেশের ন্যায় সোনারগাঁ পৌরসভায়ও অতিদরিদ্র মানুষের জন্য ৩০ টন ৮শত ১০ কেজি চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ৩ হাজার ৮১ টি দরিদ্র পরিবারের বরাদ্ধকৃত ভিজিএফ কার্ড বিতরণে নানা ফন্দিফিকিরের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ায় সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সোনারগাঁ পৌর প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ পৌরসভা কার্যালয়ের কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে তাঁর কার্যালয়ে এ কার্ড বিতরণ করেন। এতে পৌর কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান কালাম ও তাঁর নেতাকর্মীদের কারো কাছে ভিজিএফ কার্ড না দেওয়ায় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান পন্থীদের মাঝে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সোনারগাঁ পৌর প্রশাসক ও সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ জানান, পৌরসভার অতিদরিদ্র মানুষের জন্য ৩০৮০টি কার্ড বরাদ্ধ ছিল। আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত এমপি’র নিকট উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আশরাফুজ্জামান এর মাধ্যমে ১ হাজার ৯শ কার্ড, ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সাগরকে ১ শত কার্ড, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর ৩ শত কার্ড বরাদ্ধ দেওয়ার পর আমার অফিস ষ্টাফদের জন্য ৫০টি কার্ড রেখেছি। সেখান থেকেও নবনির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শ্যামলী চৌধুরী ১০ টি ও আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ১০ কার্ড নিয়ে যাওয়ায় বাকি ৩০টি কার্ড অফিস স্টাফদের দিয়েছি। বর্তমানে আমার কাছে কোন কার্ড নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সাগর মোগরাপাড়া ইউনিয়নের এবং নবনির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শ্যামলী চৌধুরী সনমান্দী ইউনিয়নের বাসিন্দা।
সোনারগাঁ পৌরসভার সচিব মাশরেকুর রহমান জানান, আমরা পৌরসভার দায়িত্বে থাকলেও নির্বাচিত মেয়র না থাকায় চরম অবহেলা ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। পৌরসভায় বরাদ্ধকৃত ভিজিএফ কার্ড নিয়মানুযায়ী পৌরবাসী পাওয়ার কথা থাকলেও সঠিকভাবে বন্টন না হওয়ায় উপিজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নে এ কার্ড চলে যাচ্ছে। তাছাড়া পৌরসভার কার্ড পৌর কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিলি না করে বর্তমান প্রশাসক তার প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামের মাধ্যমে বন্টন ও বিতরণ করায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পৌরসভার সচিবের দায়িত্বে থাকার কারনে আমার কাছে অনেক দরিদ্র মানুষ আসলেও আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি এমনকি আমার অফিসের দরিদ্র স্টাফদেরও কোন কার্ড দিতে পারিনি।
জানা যায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপির সমর্থন প্রাপ্ত প্রার্থীর আনারস প্রতিকের পক্ষে নির্বাচন না করে যারা নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান কালাম এর ঘোড়া প্রতিকের পক্ষে নির্বাচন করেছেন সেই আওয়ামী নেতাদের মাধ্যমে একটি কার্ডও বিতরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন বঞ্চিত নেতাকর্মীরা।
সরেজমিন সোনারগাঁ পৌরসভায় ভিজিএফের চাল বিতরণস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ইউএনও অঢিসের একজন স্টাফ ১২টি, আরেকজন ৭টি কার্ডে চাল উত্তোলন করছেন। এছাড়াও ১০ কেজির মধ্যে ১ কেজি চাল কম দেওয়ার অভিযোগ বিতরনকারীদের বিরুদ্ধে।
সোনারগাঁ পৌরসভার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক গাজী আমজাদ হোসেন বলেন, নিয়মানুযায়ী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডেও সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবাওে কার্ড বিতরণের কথা থাকলেও আমি ঘোড়া মার্কার নির্বাচন করায় আমাকে না জানিয়ে কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। আমাকে কার্ড বিতরণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রকৃত সুবিধাভোগীরা কার্ড পাননি বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোহিনুর ইসলাম রুমা বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের ষড়যন্ত্রের কারনে আমি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারিনি। এখন নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য বরাদ্ধকৃত ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে আমার বাড়িতে দরিদ্র মানুষ ভিড় করছে ভিজিএফ কার্ডের জন্য আমি দিতে পারছি না। অথচ আমার ৬ নম্বও ওয়ার্ডসহ ৩টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব নিয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাড. ফজলে রাব্বী। যা কোনভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না। দলীয় সরকার ও দলীয় এমপি থাকাকালীন সময় আমার মতো নির্যাতিত নেতা কর্মীরা বঞ্চনার শিকার এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে এমপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করা হলে কার্ডের ব্যাপারে তিনি আমাকে আশ^স্ত করেছেন।
হতদরিদ্র আছিয়া বেগম বলেন, ছেলে সন্তান নিয়ে খুব কস্টে থাকলেও ঘোড়া মার্কায় ভোট দেওয়ায় আমাকে কার্ড দেয় নাই বলে তিনি অঝরে কাঁদতে থাকেন। এছাড়াও পৌরসভার বাগমুছা ঋষিপাড়ার সনাতন ধর্মালম্বীদেও অনেকেই কার্ড না পাওয়ার অভিযোগ করেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ হোসাইন তার ভেরিফাইড ফেসবুক আইডিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সামসুল ইসলাম ভূইয়া বড় নেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতা পর্যন্ত কল দিয়ে কার্ড বিতরণ করছে, সবাইকে সমান ভাবে ভাগে ভাগ করে দিছে। আজ ওনি নেই, তাই ফোনটা পর্যন্ত পাইলাম না।
পৌরসভার মেয়রপ্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও যুবলীগের সাবেক সভাপতি গাজী মুজিবুর রহমান বলেন, কার্ড নিয়ে পৌরসভায় যে রাজনীতি হয়েছে তা দলের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান সোনারগাঁয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে ৪০ বছর আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া একজন পোড় খাওয়া পরিক্ষীত নেতা। ৪০ বছর ধরে রাজনীতির মাঠে আছি, নানা সময়ে হামলা মামলার শিকার হয়ে জেল জুলুম সহ নির্যাতনের শিকার হয়েছি। কিন্তু বর্তমানে সুবিধা নিচ্ছে হাইব্রিডরা। নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানের পক্ষে নির্বাচন করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রদেয় ভিজিএফ কার্ড বিরতণ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে তারা কি বোঝাতে চাচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান কালাম বলেন, আমি শান্তির রাজনীতিতে বিশ^াস করি। যারা গরিব মানুষের চাল নিয়ে আমার ও আমার নেতাকর্মীদের সাথে চালবাজি ও নোংরা রাজনীতি করছে তারা নিজেদের পায়েই কুড়াল মারছে।
আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত এমপির সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে মুঠে ফোনে যোগাযোগ করার চেস্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সোনারগাঁ পৌরসভা সুত্রে জানা যায়, গত ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবার ১৫ মাস পর সোনারগাঁ পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ দেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে পৌরসভা পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে ২০২২ সালের ১৬ মে প্রশাসকের দায়িত্ব পায় তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদ এলাহী। বর্তমান ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ পৌর প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
আপনার মতামত জানান