শ্রমিকের টাকা মেরে হাজার কোটি টাকার মালিক এমপি পাপুল

প্রকাশিত

বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে গিয়েছিলেন শ্রমিক হিসেবে, আজ তিনি সেই দেশে দুটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), নিজ দেশে ব্যাংকের পরিচালকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। আলিশান বাড়ি-গাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। শুধু কি সম্পদশালী? কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই এখন সংসদ সদস্য। নিজে স্বতন্ত্র থেকে সংসদ সদস্য এবং স্ত্রী কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য। আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এই ব্যক্তি হচ্ছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। যাঁর বিরুদ্ধে কুয়েতে মানবপাচারের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে দেশটির গণমাধ্যমে।

এমপি কাজী শহীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের এক সভায় অনুসন্ধানের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সভায় দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের সই করা একটি চিঠির বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয় যেখানে এমপি কাজী শহীদের বিরুদ্ধে কমিশন খেয়ে ব্যাংকঋণ বরাদ্দসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারে তথ্য পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। দুদক পরিচালকের চিঠির সঙ্গে ১৭৪ পাতার একটি নথির ফাইলও যোগ করা হয়েছে বলে কমিশনের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য চলতি সপ্তাহেই দুদকের একজন কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সভায় জানানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, কাজী শহীদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থপাচার ও ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন বাণিজ্য করার অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে কমিশনে।

সম্প্রতি কুয়েত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির বরাত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশটির পত্রিকা আল কাবাস ও আরব টাইমস। প্রতিবেদনে এই সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ করা না হলেও এ বিষয়ে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলই ওই সংসদ সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংসদ সদস্যসহ তিনজনের চক্রটি অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে পাঠিয়ে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে বলে কুয়েতের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়।

লক্ষ্মীপুরে আকস্মিক উদয়

কাজী শহীদের বিরুদ্ধে কুয়েতে মানবপাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ আর দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকা লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের একাংশ) আসনেও বেশ আলোচনা চলছে। রাজনীতির বাইরে থাকা ‘ভাগ্যবান’ এ দম্পতি টাকার বিনিময়ে কেন্দ্র ও জেলা আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মীকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে রেখেছেন বলেও আলোচনা আছে। যদিও লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তাঁকে ‘নব্য হাইব্রিড’ আখ্যা দিয়ে একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত হলেও তা অদৃশ্য কারণে বাস্তবায়ন হয়নি।

জানা গেছে, ১৯৯২ সালে ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরে শহীদ ইসলাম কুয়েত যান। বর্তমানে তিনি মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপ অব কম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এ ছাড়া তিনি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান।

লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা শহীদ ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি স্থানীয় একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে সংবাদকর্মীদের নিয়ে মতবিনিমিয় করেন। জন্মের পর তখনই প্রথম এসেছেন জানিয়ে রায়পুরকে জেলায় রূপান্তর করাসহ একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাক্কি বিল্লাহর হাত ধরে তিনি কিছু দান-খয়রাত করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে ‘দানবীর’ ও ‘মানবতার সেবক’ হিসেবে প্রচার চালান তাঁর অনুসারীরা।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটগত কারণে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে মনোনয়ন দেয়। তখন শহীদ স্বতন্ত্র (আপেল প্রতীক) প্রার্থী হন। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মোহাম্মদ নোমান নাটকীয়ভাবে গাঢাকা দেন। তখন অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন শহীদ। এরপর শহীদ এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে নিজের স্ত্রী সেলিনা ইসলামের জন্যও বাগিয়ে নেন কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের এমপির পদটিও। সেলিনা কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।

শহীদ ইসলাম টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় দুই-তিনজনের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের জেলা বা উপজেলা কমিটির সদস্য নন। এর পরও রায়পুরে আওয়ামী লীগের একাধিক সভায় তাঁকে প্রধান অতিথি করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

গত বছর জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় শহীদ ইসলাম পাপুলকে নব্য হাইব্রিড আখ্যা দিয়ে একাধিক নেতা বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁরা বলেন, পাপুল আওয়ামী লীগের কেউ নন। তখন দলীয়ভাবে তাঁকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরও তাঁকে দলের কর্মসূচিতে দেখা যায়। রায়পুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহসান মাল বলেন, পাপুল কোনো সভাতে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে একটি শব্দও বলেন না। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। কৌশলে তিনি বিএনপি-জামায়াতের মিশন বাস্তবায়ন করছেন বলে মনে হচ্ছে।

এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতি মাসেই শহীদ ইসলাম এলাকায় আসেন। মাঝেমধ্যে দুই-এক রাত তাঁর রায়পুর পৌরসভার কেরোয়ার কাজী বাড়িতেই অবস্থান করেন। প্রশাসনের সভা এবং সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে তিনি সকালে বা দুপুরে হেলিকপ্টারে এসে কাজ সেরে আবার বিকেলেই হেলিকপ্টারে ঢাকায় ফিরে যান। গত বছর তিনি হেলিকপ্টারে এসে সোনাপুর ও চরবংশীসহ কয়েকটি স্থানে কম্বল বিতরণ করেছেন। এ জন্য অনেকেই বলাবলি করেন, শহীদ ইসলাম হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। তিনি হেলিকপ্টারে উড়ে এসে উড়ে যান, এলাকায় তেমন থাকেন না।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজী শহীদ বলেন, ‘আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করি। কোনো মানবপাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। বিদেশি কোনো গণমাধ্যমে আমার নাম আসেনি। ব্যাবসায়িক ও জনপ্রিয়তার কারণে আমার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’

সুত্র : কালের কন্ঠ

আপনার মতামত জানান