রমজানকে বিদায় জানাবেন যেভাবে
মহিমান্বিত মাস রমজানের এখন বিদায়লগ্ন। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসা রমজান বিদায় নেবে কয়েক দিন পরই। তাই সময় হয়েছে নিজের হিসাবটা বুঝে নেওয়ার। কতটা অর্জন আমরা করতে পারলাম আর কতটা অবহেলায় কাটল সময়। রমজানের বিদায়লগ্নে পূর্বসূরি পুণ্যাত্মা মনীষীদের মধ্যে ভীতি ও প্রীতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হতো। যেমন তাঁরা আশায় বুক বাঁধতেন মহামহিম আল্লাহ হয়তো তাঁদের ক্ষমা করে দেবেন, তেমনি ভয় পেতেন রমজানে আল্লাহর মুক্ত ভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত হওয়ার। তাঁরা আল্লাহর কাছে রমজানের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইতেন এবং রমজানের মূল শিক্ষা খোদাভীতি প্রাপ্তির প্রার্থনা করতেন।
১. কবুলের দোয়া করা : ইয়াহইয়া ইবনে কাসির (রহ.) রমজানের শেষরাতে দোয়া করতেন—(উচ্চারণ) আল্লাহুম্মা সাল্লিমনি ইলা রামাদান, ওয়া সাল্লিম লি-রামাদান, ওয়া তাসাল্লামহু মিন্নি মুতাকাব্বালান। (অর্থ) হে আল্লাহ! আমাকে (আগামী) রমজান পর্যন্ত সুস্থ রাখুন। রমজানকে আমার জন্য নিরাপদ করুন। রমজানকে (রমজানের ইবাদতগুলো) আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন।
আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘আমাদের পূর্ববর্তী মনীষীরা রমজানের আগে ছয় মাস রমজানপ্রাপ্তির দোয়া করতেন এবং রমজানের পরে ছয় মাস রোজা ও ইবাদত কবুলের দোয়া করতেন।’ রমজান বিদায় নেওয়ার পর খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তাঁর ঈদের খুতবায় দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা ও ইবাদত করার জন্য মানুষকে অভিনন্দন জানাতেন এবং উপদেশ দিতেন রোজা কবুলের দোয়া করতে।
২. ভুলত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হওয়া : মনীষীরা রমজানের শেষে তাঁদের ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য অনুতপ্ত হতেন। আলী (রা.) রমজানের শেষরাতে বলতেন, ‘হায়! যদি আমি জানতাম রোজা কবুল হয়েছে, তাহলে অভিনন্দন জানাতাম অথবা জানতাম বঞ্চিত হয়েছি, তাহলে অনুতপ্ত হতাম।’
৩. পাপ থেকে বিরত থাকার প্রত্যয় : রমজানে মুমিন ইবাদত-বন্দেগি ও সাধনার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করবে এবং সারা বছর আল্লাহর অনুগত হয়ে চলবে। তাই রমজান শেষে কাউকে পাপের পথে ফিরে যেতে দেখলে মনীষী আলেমরা ব্যথিত হতেন। কাব (রা.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রাখে এবং মনে মনে প্রত্যয় গ্রহণ করে রমজানের পর আল্লাহর অবাধ্য হবে না, সে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে রোজা রাখে এবং মনে মনে বলে, ফিতরের পর আল্লাহর অবাধ্য হবে, তার রোজা প্রত্যাখ্যাত হবে।’
৪. ইবাদত অব্যাহত রাখার প্রত্যয় : বিশর হাফি (রহ.) বলতেন, ‘কিছু মানুষ রমজানে আল্লাহর ইবাদত করে এবং ভালো কাজে আত্মনিয়োগ করে। রমজানের পর তা ছেড়ে দেয়। কতই না নিকৃষ্ট সেসব মানুষ, যারা শুধু রমজানেই আল্লাহকে চেনে।’
৫. আল্লাহর প্রতি আশাবাদ : মনীষীরা শুধু ব্যথিত হতেন না, বরং তাঁরা আল্লাহর প্রতি আশাবাদী হতেন। আল্লাহর দরবারে নিজের ভুলত্রুটির জন্য লজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি রমজানের রোজা ও অন্যান্য ইবাদত কবুলের আশা রাখতেন। কেননা বান্দার প্রতি আল্লাহর করুণার ধারাই বেশি প্রবল।
৬. আনন্দের নামে উন্মাদনা নয় : রমজান শেষে নিশ্চিন্ত আনন্দ ও উন্মাদনা মনীষীরা অপছন্দ করতেন। তাঁরা পছন্দ করতেন সংযত আনন্দ, যাতে খোদাভীতির ছাপ থাকে। ওহাব ইবনুল ওয়ারদ (রহ.) একদল মানুষকে ঈদের দিন খুব হাসতে দেখে বললেন, ‘এ মানুষগুলোর রোজা যদি কবুল হয়ে থাকে, তবে তাদের আনন্দ কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। আর যদি তা কবুল না হয়, তবে কোনো মুত্তাকি মানুষ কি এভাবে হাসতে পারে?’
হাসান বসরি (রহ.) বলতেন, ‘আল্লাহ বান্দাকে রমজান মাস দান করেছেন আমলের প্রতিযোগিতার জন্য। একদল তাতে অগ্রসর থাকে, তারাই সফল এবং একদল পিছিয়ে পড়ে, তারাই ব্যর্থ। কী আশ্চর্য! আজ সফল ও ব্যর্থ সবাই সমান আনন্দ-ক্রীড়া-কৌতুকে মেতেছে।’
তাই আসুন! রমজানের বিদায়বেলায় নিজেদের প্রাপ্তির হিসাবটা মিলিয়ে নিই। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হই এবং ইবাদতগুলো কবুলের প্রার্থনা করি। সর্বোপরি সারা বছর পাপমুক্ত জীবনের প্রত্যয় গ্রহণ করি। পাপ পরিহার করতে পারলেই ঈদ আমাদের জন্য যথার্থ হবে। কেননা আলী (রা.) বলতেন, পাপমুক্ত প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য ঈদ।
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ
আপনার মতামত জানান