যেভাবে বের করবেন জাকাতের হিসাব

প্রকাশিত

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হচ্ছে জাকাত। ঈমানের পর নামাজ, তার পরই জাকাতের স্থান।

জাকাত স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক এমন মুসলিম নর-নারী আদায় করবে, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে। তবে এর জন্য শর্ত হলো—

১. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে।

২. সম্পদ উত্পাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে।

৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে।

৪. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই শুধু জাকাত ফরজ হবে।

৫. জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে।

৬. কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই শুধু ওই সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে।

জাকাতের নিসাব : ক. সোনা ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম (প্রায়)। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম (প্রায়)। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৩৯৪, আল ফিকহুল ইসলামী : ২/৬৬৯)

দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যাবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। তাই মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং যার কাছে ৫২.৫ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যাবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে।

যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫ শতাংশ) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৭২, সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)

যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ : সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।

সোনা-রুপার অলংকার সব সময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক, সর্বাবস্থায় তার জাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ শরিফ : ১/২৫৫, নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮)

ব্যাংক ব্যালান্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ।

টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭)

হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাতেও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)

দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)

ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক, যেমন—জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি, যেমন—মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বই-পুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩)

যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এই পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮১)

ভূমি বা প্লটের জাকাত : এক. যদি ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে ভূমি বা প্লট ক্রয় করা হয়, তাহলে প্রতিবছর ভূমি বা প্লটের বাজারমূল্য বিবেচনা করে জাকাত দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ—কেউ যদি পাঁচ লাখ টাকায় পাঁচটি প্লট ক্রয় করে, তারপর এক বছরের মাথায় ওই প্লটের বাজারমূল্য সাত লাখ হয়ে যায়, তাহলে তাকে সাত লাখ টাকার জাকাত দিতে হবে।

দুই. যদি নিজের বসবাসের জন্য ক্রয় করা হয়, তাহলে ওই প্লটের জাকাত দিতে হবে না। তা ছাড়া ব্যবসা বা বসবাসের উদ্দেশ্য ছাড়া এমনিতে ক্রয় করলেও ওই জমি বা প্লটের জাকাত দিতে হবে না।

(আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২৮৪)

আর ভাড়া দেওয়ার জন্য যে বাড়ি করা হয়, তার ভাড়ার ওপর জাকাত আসবে—মূল বাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত আসবে না। বাৎসরিক বাড়িভাড়া যদি সার্বিক খরচের অতিরিক্ত হয়ে জাকাতের নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার জাকাত দিতে হবে।

দোকানের পণ্যের জাকাত : দোকানের ডেকোরেশন, আলমারি, তাক ইত্যাদি মূল্যের ওপর জাকাত ফরজ নয়, বরং সেল বা বিক্রি করার জন্য যেসব পণ্য বিদ্যমান, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তাতে জাকাত ফরজ হবে। জাকাত হিসাব করার পদ্ধতি হলো—বছরের একটা সময় দিন-তারিখ নির্ধারণ করে দোকানে বিদ্যমান পণ্যের মূল্যের হিসাব করে দেখা গেল, পাঁচ লাখ টাকার পণ্য আছে। অতঃপর ওই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আবার আনুমানিক পণ্যের মূল্য ধরে দেখা গেল, শুরুতে যে পরিমাণ সম্পদ ছিল, তা নিসাব পরিমাণ। আবার এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যে পণ্য আছে, তা-ও নিসাব পরিমাণ, তাহলে সমুদয় সম্পদের আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হবে। (তাতারখানিয়া : ৩/১৬৯, হিন্দিয়া : ১/১৮০, আদ্দুররুল মুখতার : ৩/১৮২)

ব্যাংকে সঞ্চয়কৃত টাকার জাকাত : কোনো ব্যক্তি সঞ্চয়ের জন্য যদি ব্যাংকে টাকা জমা রাখে, তাহলে ঋণমুক্ত অবস্থায় যেদিন তার জমাকৃত টাকা নিসাব পরিমাণ হবে, সেদিন থেকে এক বছর পূর্ণ হলে ওই টাকার ওপর জাকাত দিতে হবে। (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরী : ১/২৭০, মাহমুদিয়া : ৩/৫৭)

প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর জাকাতের বিধান : সরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য বাধ্যতামূলক যে পরিমাণ টাকা কর্তন করে রাখা হয়, সেই পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের আগে কর্মচারীর মালিকানায় আসে না। তাই সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডে অর্থ থাকাকালীন তার ওপর জাকাত দিতে হবে না। এ কারণে ওই ফান্ডের টাকা পাওয়ার পর বিগত বছরের জাকাতও দিতে হবে না। তবে যদি কর্মচারী ওই প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চিত অর্থ অন্য কোনো ইনস্যুরেন্স কম্পানিতে স্থানান্তর করিয়ে নেয়, সে ক্ষেত্রে ওই অর্থ স্বতন্ত্রভাবে বা অন্য জাকাতযোগ্য মালের সঙ্গে যোগ হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে যথানিয়মে তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৬০ পৃষ্ঠা, ফাতাওয়ায়ে শামি : ২/৩০৬)

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ

আপনার মতামত জানান