যুবদল নেতা রবির নেতৃত্বে চলে বালু উত্তোলন ও নৌ চাঁদাবাজি। বাধা দিলেই হামলা, মামলা

হোমনা (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
সম্প্রতি বালু উত্তোলন নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির দুটি পক্ষের নেতাকর্মী। গত ১১ মার্চ রাতে চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বারেক প্রধান ও ইউনিয়ন যুবদলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম রবির মধ্যে বালু উত্তোলন নিয়ে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনার পর থেকে চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছানাউল্লাহ সরকার, স্বপন দেওয়ান, জামান মিয়া, রাজু মিয়াকে নিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছেন যুবদল নেতা রবি।
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের মেঘনা নদীতে প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মচ্ছব। সময়ের সঙ্গে বদলেছে নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী, কিন্তু বন্ধ হয়নি বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের গোপন সমর্থনেই এভাবে বালু উত্তোলন চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে মেঘনায় বালু উত্তোলনের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের একটি সিন্ডিকেটের হাতে। এখন সেই নিয়ন্ত্রণ এসেছে বিএনপির একাংশের কাছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মেঘনা উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি মাহবুবা ইসলাম মিলিও বালু উত্তোলনে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের মিল না হওয়ায় বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তিনি। স্থানীয়দের দাবি– যখন ভাগ পান, তখন চুপ থাকেন; আর যখন বঞ্চিত হন, তখনই সরব হন মিলি।
উপজেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালানোর কথা বললেও বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি; বরং রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে প্রশাসনের গোপন সমঝোতার অভিযোগই বেশি। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসন একদিকে বালু উত্তোলন বন্ধের ঘোষণা দেয়, অন্যদিকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও সংশ্লিষ্টতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন একাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে মেঘনা উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি মাহবুবা ইসলাম মিলি বলেন, ‘আমি চাই বালু উত্তোলন বন্ধ হোক। প্রতিনিয়ত প্রশাসনকে জানাচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ তুলেছে, তারা মিথ্যা বলছে। আমি সবসময় বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান করছি, ঈদের পর অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করব।’
চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান জানান, প্রতি রাতে রবিউল ইসলাম রবি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। মাহবুবা মিলির স্বামী একসময় এই সিন্ডিকেটের অংশ ছিল। মনে হয় এখন ভাগ কম পায় বা পায় না, তাই বিরুদ্ধে গিয়েছে।
কথা হয় মেঘনা উপজেলা শ্রমিক দলের সদস্য সচিব মহসিন প্রধানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা একই গ্রুপে ছিলাম। নৌপথে চাঁদাবাজির জন্য পুলিশ রবির লোককে ধরলে তা নিয়ে রবি আমাদের দোষারোপ করে। এর জেরেই রবি ও তার লোকজন আমাদের ওপর হামলা করে।’ এ ঘটনার পর থেকে রবি চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সানাউল্লা সরকার, স্বপন দেওয়ান, জামান মিয়া, রাজু মিয়াদের সঙ্গে নিয়ে বালু উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ তাঁর।
তবে অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে রবিউল ইসলাম রবিকে কল দেওয়া হলে রিসিভ করেননি। পরে কথা হয় চালিভাঙ্গা নৌ-পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজমগীর হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা বুধবার থেকে টহল দিচ্ছি। মানুষ যা চায় আমরা যেহেতু সেটা করতে পারছি না, আমাদের নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই।
আমার সিনিয়র অফিসার, ইউএনও, ওসি, সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছি, এই বালু উত্তোলন ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধে কাজ করছি।’ বালু উত্তোলনের হোতা রবিউল্লাহ ইসলাম রবি বুধবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘নৌপথে চাঁদাবাজি যাতে না হয়, বদনাম যাতে না হয় সেই ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হ্যাপী দাস জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অভিযান চলছে, টানা দুই মাস চলবে অভিযান। কোস্টগার্ডও অভিযানে রয়েছে। স্থায়ীভাবে কোস্টগার্ডের যেন স্থাপনা হয়, টহল হয়, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে– প্রশাসনের এই অভিযান অনেক ক্ষেত্রেই লোক দেখানো হয়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি; বরং রাজনৈতিক দলের নেতাদের আশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
প্রশাসন প্রতিবারের মতো এবারও অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের প্রশ্ন, এসব অভিযান কি আদৌ কার্যকর হবে, নাকি আগের মতোই লোক দেখানো উদ্যোগ হিসেবে থেকে যাবে। মূল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বালুখেকোদের থামানো যাবে না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
আপনার মতামত জানান