মুসলিম পরিবারে রমজানের ভূমিকা
রমজান মাস মুমিনের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ। এই মাসে আল্লাহ ভালো কাজের প্রতিদান বাড়িয়ে দেন, মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, পাপীদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং মুমিনের দোয়া কবুল করেন। ফলে মুমিন রমজান মাস লাভের জন্য প্রার্থনা করে এবং তা লাভ করলে খুশি হয়। রাসুল (সা.) রজব মাস শুরু হলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং রমজানে পৌঁছে দিন।’ (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৩৯৩৯)
মুসলিম পরিবারে রমজানের আবহ : রমজানের মাহাত্ম্য অর্জনে ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি পারিবারিক পরিমণ্ডলেও পবিত্র আবহ সৃষ্টি করা আবশ্যক। রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারকে তাহাজ্জুদে উদ্বুদ্ধ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক এলে রাসুল (সা.) কোমর শক্ত করে বেঁধে নিতেন, রাত জেগে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪)
রমজানে পরিবারের করণীয় ও বর্জনীয়
রমজানে মুসলিম পরিবারের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো হলো—
১. রমজানের মাহাত্ম্য তুলে ধরা : রমজান এলে পরিবারের সবার সামনে রমজানের মাহাত্ম্য তুলে ধরা আবশ্যক, যেন ছোট-বড় সবাই রমজানের কল্যাণ লাভে আগ্রহী হয়। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) মিম্বারে উঠলেন। তিনি প্রথম সিঁড়িতে উঠে বলেন, আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠেও বলেন, আমিন। তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে উঠেও বলেন, আমিন। সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা আপনাকে তিনবার আমিন বলতে শুনলাম। তিনি বলেন, আমি প্রথম সিঁড়িতে উঠতেই জিবরাইল এসে বলেন, দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তির, যে রমজান মাস পেল এবং তা শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার গুনাহর ক্ষমা হলো না। আমি বললাম, আমিন।…’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৬৪৬)
২. বিধি-বিধান আলোচনা : রমজানের বিধি-বিধান আগে থেকে জানা থাকলেও রমজানের শুরুতে তা আলোচনা করে নেওয়া উত্তম, যেন সবাই সতর্ক ও সচেতন থাকে এবং কোনো বিধান ভুলে গেলে তা স্মরণে চলে আসে। ধর্মীয় বিষয়ে পারিবারিক অসচেতনতা নিন্দনীয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যাতে তুমি সতর্ক করতে পারো এমন এক জাতিকে, যাদের পিতৃপুরুষদের সতর্ক করা হয়নি, ফলে তারা গাফিল।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৬)
৩. পাপ বর্জন করা : পরিবারের প্রত্যেক সদস্য নিজে পাপ থেকে বিরত থাকবে এবং অন্যকেও বিরত রাখবে। কেননা রমজানে কল্যাণ ও প্রতিদান লাভের পূর্বশর্ত পাপ পরিহার করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
৪. পানাহারে দীর্ঘ সময় নষ্ট না করা : রমজানে সাধারণত ইফতার ও সাহরির সময় পানাহার করা হয়। দোয়া, প্রার্থনা ও ইবাদতের জন্য সময় দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দুই সময় আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না—ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৫২)
অন্যত্র নবী (সা.) বলেন, ‘রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে আমাদের প্রতিপালক পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন—কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব, কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব, কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৪৫)
৫. ভালো কাজে প্রতিযোগিতা : রমজানে আল্লাহ ভালো কাজের প্রতিদান বাড়িয়ে দেন। তাই পরিবারে ভালো কাজে প্রতিযোগিতা হওয়া আবশ্যক। বিশেষত কোরআন তিলাওয়াত বেশি পরিমাণ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৮)
৬. তাহাজ্জুদের প্রতি যত্নশীল হওয়া : রমজানে পরিবারিকভাবে চেষ্টা করা উচিত, যেন সবাই তাহাজ্জুদ আদায় করে। কেননা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক এলে রাসুল (সা.) কোমর শক্ত করে বেঁধে নিতেন, রাত জেগে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪)
৭. পারিবারিক কাজে সহযোগিতা : রমজানে পারিবারিক কাজের চাপে নারীরা ইবাদতে মনোযোগী হতে পারে না। তাই ছোট-বড় সবার উচিত পারিবারিক কাজে সাহায্য করা। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) জুতা ঠিক করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো তেমনি কাজ করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৫৩৮০)
৮. শিশুদের রোজায় অভ্যস্ত করা : প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুদের জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়, তবে সাহাবিরা শৈশব থেকে সন্তানদের রোজায় অভ্যস্ত করে তুলতেন। রুবাইয়া বিনতে মুআব্বিজ (রা.) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ওই দিন (আশুরা) রোজা পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের রোজা পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৬০)
৯. অসহায় আত্মীয়দের পাশে দাঁড়ানো : রমজানে দান করতে এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষত কারো নিকটাত্মীয় অসহায় হলে তার খোঁজখবর নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন উলামায়ে কেরাম। কেননা মহানবী (সা.) রমজানে বেশি বেশি দান করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল। রমজানে যখন জিবরাইল তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন তখন তাঁর দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬)
১০. নামাজে যত্নশীল হওয়া : রমজানে অলসতা ও ঘুমের কারণে বহু মানুষের ফজরের নামাজ ছুটে যায়। এ ক্ষেত্রে অন্যদের উচিত তাকে সতর্ক করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি নিকট আত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দিন।’ (সুরা : শুআরা, আয়াত : ২১৬)
আল্লাহ প্রতিটি মুসলিম পরিবারে দ্বিনি পরিবেশ তৈরি করে দিন। আমিন।
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ
আপনার মতামত জানান