মানবতার একনিষ্ঠ সেবক – ডা. কামরুল ইসলাম

প্রকাশিত


জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুল ইসলাম। কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সরকারি চাকরি সূত্রে যে অর্থ আয় করেছিলেন, সেই টাকায় তিনি নিজের জন্য বাড়ি-গাড়ি না করে কিনেছিলেন ডায়ালাইসিস মেশিন। সেই মেশিনের সাহায্যে নামমাত্র খরচে গরীব রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন মানবতার এই একনিষ্ঠ সেবক।

পাবনার ঈশ্বরদীর এই কৃতী সন্তান বিনা পারিশ্রমিকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭টি কিডনি প্রতিস্থাপন করে এরইমধ্যে দেশ-বিদেশে আলোচনায় এসেছেন। দরিদ্র মানুষের শুধু কিডনি প্রতিস্থাপনই করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, একইসঙ্গে কিডনির সক্রিয়তা নিশ্চিতকরণে বিনা পয়সায় মাসিক ফলোআপ-এর ব্যবস্থাও করে আসছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার অনুপ্রেরণা আর মানবসেবায় ব্রত হয়েই চিকিৎসাসেবা বেছে নিয়েছিলেন কামরুল ইসলাম। তিনি আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক কর্মকর্তা ও ঈশ্বরদীর আমিনপাড়া গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম আমিনের মেজো সন্তান।

এসএসসি পাস করা রহিমা খাতুন স্বামীকে হারানোর পর তার চার ছেলেকে মানুষ করার জন্য এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আবার পড়াশুনা শুরু করেন। এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সমাজবিজ্ঞানে ১ম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৮১ সালে রহিমা খাতুন ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে যোগদান করেন। অন্যদিকে মেজো ছেলে কামরুল ইসলাম ঈশ্বরদীর চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৩তম স্থান অর্জন করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এরপর এইচএসসিতেও দশম স্থান অধিকার করেন কামরুল। ১৯৮২ সালে দেশে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়ন শুরু করেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৯ সালে পাস করে ইন্টার্নশিপ শেষ করেন ১৯৯০ সালে। পরবর্তীতে একাদশ বিসিএসে ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করেন। ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরু হয় তার সরকারি চাকরি।

পরবর্তীতে তিনি ইউরোলজিতে ৫ বছর মেয়াদি এমএস প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন এবং জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট শুরু করেন। সরকারি হাসপাতালের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি ২০১১ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শ্যামলীতে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন কিডনি হাসপাতাল।

অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ২০১৪ সালে অসহায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। করোনা মহামারির মধ্যে গণস্বাস্থ্য কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার ছাড়া যখন সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগীদের সেবা বন্ধ ছিল, তখনও সিকেডি হাসপাতাল তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।

সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের অবস্থান ঢাকার শ্যামলীর ৩ নম্বর সড়কে। ছয়তলার একটি সাদামাটা ভবনে চলছে এই প্রতিষ্ঠানের মানবিক কার্যক্রম। এখানে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এই সেবায় ১৫ দিনের প্যাকেজের মধ্যে আছে ২ জনের অস্ত্রোপচার খরচ (রোগী ও ডোনার), বেড ভাড়া ও ওষুধ খরচ।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর চেয়ে কম খরচে দেশের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। পাশের দেশ ভারতেও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য খরচ হয় ১৫ লাখ টাকার বেশি। এছাড়া সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও তুলনামূলক কম। কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলে সিকেডি হাসপাতালেই তার ব্যবস্থা আছে। আছে ২২ বেডের একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট। খরচ দেড় হাজার টাকা। আইসিইউ শয্যার খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।

এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করা সব রোগীর ফলোআপ পরীক্ষা করা হচ্ছে বিনামূল্যে। প্রতি মাসে এখানে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী আসেন ফলোআপ পরীক্ষার জন্য। তাদের সবার ফলোআপ বিনামূল্যে করানো হয়।

অধ্যাপক কামরুল জানান, এই ফলোআপের কারণে রোগীর কিডনি অনেক দিন সুস্থ থাকে। যদি ফলোআপ পরীক্ষার জন্য টাকা নেওয়া হতো, তাহলে রোগীদের বড় একটি অংশ কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ফলোআপ পরীক্ষা করতে আসতেন না। তাতে অনেকেরই কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকত। তিনি জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীর ভালো থাকার অন্যতম শর্ত এই ফলোআপ। প্রথমদিকে প্রতি মাসে ১ বার, পরবর্তীতে ২-৩ মাস পর পর এই ফলোআপের দরকার হয়। প্রতিদিন অনেক রোগী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাসপাতালে ফলোআপের জন্য আসেন।

তিনি আফসোস করে বলেন, এসব রোগীদের বেশির ভাগই দরিদ্র শ্রেণির। দেখা যায় সারারাত জার্নি করে তারা ঢাকায় আসেন। সারাদিন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি যান। মাঝের সময়টাতে তাদের একটু বিশ্রাম ও খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তি পেতাম। কিডনি রোগীর জন্য সেটা খুব জরুরি।

অধ্যাপক কামরুলের মানব হিতৈষী কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. কেএম আবু জাফর বলেন, সরকারিভাবে তার (ডা. কামরুল ইসলাম) কাজের স্বীকৃতি দিলে দেশের জন্য অনেক ভালো হবে। অন্য দেশে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে গেলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। আর কামরুল ইসলাম মাত্র ২ লাখ টাকায় সেটি সম্পন্ন করে থাকেন। তাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত।

আপনার মতামত জানান