মহিমান্বিত রাতে মুমিনদের আমল
মাওলানা মো. আমিনুল ইসলাম
মহান আল্লাহ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতকে যেসব বিশেষ সম্মাননা দিয়েছেন, এর মধ্যে উল্লেযোগ্য একটি নিয়ামত হচ্ছে লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী। রাতটির বিশেষত্ব হলো, তা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। অর্থাৎ এই একটি রাতের ইবাদত করা ৮৪ বছর একটানা ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রাতে জেগে ইবাদত করলে আগের সব গুনাহ ক্ষমা করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কেউ ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাজ পড়লে তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করা হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০১)
এসব মর্যাদার কারণে মহানবী (সা.) তাঁর পরিবার-পরিজনকে রমজান মাসের শেষ দশকের রাতে জাগিয়ে তুলতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রমজান মাসের শেষ দশকের রাত উপস্থিত হলে রাসুল (সা.) রাতে জেগে থাকতেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৪) তিনি অত্যন্ত উদ্দীপনার সঙ্গে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন এবং সাংসারিক বা পারিবারিক কাজ বন্ধ রাখতেন।
অনেকে মনে করে, ২৭ রমজানের রাতই শবেকদর। তবে এই ধারণা সঠিক নয়। মহানবী (সা.)-এর কর্মপন্থা এমনটি ছিল না। তবে অনেক সাহাবি ও তাবেয়িদের মতে রমজানের ২৭তম রাত শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সবার উচিত, রমজানের শেষ দশকের সব রাত গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানো। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চাইলে সে যেন তা রমজান মাসের শেষ দশ রাতে খোঁজ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০১৭)
রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশ রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কোরো।’
কেউ পুরো ১০ রাত জেগে ইবাদত করতে অপারগ হলে সবাই যেন অন্তত শেষ সাত রাতে ইবাদত করার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করি। এক্ষেত্রে কেউ যেন কোনোভাবেই শৈথিল্য না করে। তাই বিভিন্ন হাদিসে বিজোড় রাতগুলোর প্রতি বেশি গুরত্ব দিতে বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে। অতঃপর তা ভুলিয়েও দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বিজোড় রাতগুলোতে তা খোঁজ কোরো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৭)
মহানবী (সা.) লাইলাতুল কদরের উদ্দেশ্যে রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতে সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে তারাবির নামাজ বা তাহাজ্জুদের আদায় পড়তেন। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ২৩তম রমজান মাসের রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত আমাদেরকে নিয়ে নামাজ পড়েছেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমরা যা খোঁজ করছ তা সম্ভবত সমানে রয়েছে।’ এরপর রমজানের ২৫তম রাতে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল করেন। এবারও তিনি বললেন, ‘তোমরা যা খুঁজছ তা সম্ভবত সামনে রয়েছে। এরপর মহানবী (সা.) ২৭তম রাতে পরিবারের সদস্য ও আমাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে ভোর পর্যন্ত জামাতে নামাজ পড়েছেন। এমনকি আমরা ভয় পেলাম, হয়তো সাহরি খাওয়ার সময়ও পাব না। (তিরমিজি)
উল্লিখিত হাদিসে রমজানের ২৭তম রাতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসের প্রতি রাতেই সম্ভব হলে কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার চর্চা করা উচিত। বিশেষত শেষ দশকের রাতগুলোতে শবেকদরের বরকত লাভের আশায় কিয়ামুল লাইল করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন রীতি অনুসরণ করতে হবে। রাতে এশা ও তারাবির নামাজের পর কিছু সময় ঘুমাবো। ঘুম থেকে ওঠে আমরা সাহরি পর্যন্ত শবে কদরের বরকত লাভের আশায় ইবাদতে নিমগ্ন হবো। এসময়ে আমরা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, দরুদসহ বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে রাত জাগতে পারি।পারলে মহল্লার মসজিদে হাফেজদের মাধ্যমে দীর্ঘ তিলাওয়াতের তাহাজ্জুদ নামাজ আয়োজন করতে পারি। বিশেষ করে বিজোড় রাতে গুরুত্বসহ ইবাদত করতে পারি।
মহানবী (সা.), সাহাবায়ে কেরাম (রা.), তাবেয়ি (রহ.) ও সালাফে সালেহিন রমজানের শেষ দশকে কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। আয়েশা (রা.) বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করি, হে আল্লাহর রাসুল, কদরের রাতে আমি কি দোয়া করব? উত্তরে মহানবী (সা.) বলেছেন, তুমি পড়বে,
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিববুল আফওয়া ফাফু আন্নি।’
অর্থ- ‘হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১৩)
এ ধরনের আরো কিছু দোয়া আমরা করতে পারি। যেমন-
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي كُلَّهُ دِقَّهُ وَجِلَّهُ وَأَوَّلَهُ وَآخِرَهُ وَعَلاَنِيَتَهُ وَسِرَّهُ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি জামবি কুল্লাহু দিক্কাহু ওয়া জিল্লাহু ওয়া আউওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু ওয়া আলানিয়্যাতাহু ওয়া সিররাহু।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আমার সব গুনাহ ক্ষমা কোরো। ছোট ও বড় গুনাহ। আগের ও পরের গুনাহ। প্রকাশ্য ও গোপন গুনাহ।’
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদরের বরকত লাভের তাওফিক দান করুন।
আপনার মতামত জানান