মহানবী (সা.) হাদিসচর্চাকারীর জন্য যে দোয়া করেছেন

প্রকাশিত

কোরআনের পর শরিয়তের দ্বিতীয় গ্রহণযোগ্য দলিল সুন্নাহ বা হাদিস। এর মাধ্যমে কোরআনের বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায় হাদিসে। জীবনঘনিষ্ঠ বহু সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছে সুন্নাহর মাধ্যমে। আল্লাহ কোরআনের মতো হাদিসকেও যথাযথ সংরক্ষণ করেছেন। যাঁরা এই সংরক্ষণপ্রক্রিয়ায় জড়িত, তাঁরা সম্মানিত ও মর্যাদাবান।

বিশুদ্ধ হাদিসচর্চার গুরুত্ব : জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কাছে থেকে কোনো হাদিস শুনে তা মুখস্থ করে এবং অন্যের কাছে তা পৌঁছে দেয়, আল্লাহ তাকে চির উজ্জ্বল করে রাখবেন। কেননা বহু সময় যার কাছে হাদিস পৌঁছানো হয়, সে শ্রবণকারী থেকে বেশি অনুধাবনকারী হয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬৬০)

বিপরীতে যারা ধারণাপ্রসূত, অনুমানভিত্তিক এবং যাচাই-বাছাই ছাড়া হাদিস বর্ণনা করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ঘোষণা। মুগিরা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে ‘আমার প্রতি মিথ্যারোপ করা অন্য কারো প্রতি মিথ্যারোপ করার মতো নয়। যে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, সে অবশ্যই তার ঠিকানা জাহান্নামে করে নেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯১)

বিশুদ্ধ হাদিসচর্চায় করণীয় : ভিত্তিহীন বর্ণনা থেকে বাঁচতে এবং বিশুদ্ধ হাদিসচর্চায় কয়েকটি করণীয় তুলে ধরা হলো।

১. সনদ যাচাই : হাদিস সংরক্ষিত হয়েছে সনদের মাধ্যমে। রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনাকারীদের যে সূত্র বা পরম্পরায় হাদিস আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাকে সনদ বলে। আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) বলেন, ‘সনদ দ্বিনের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। যদি সনদ না থাকত, যার যা ইচ্ছা তা-ই বলত।’ (মুকাদ্দিমা সহিহ মুসলিম, পৃষ্ঠা ১২)

সুতরাং কোনো একটি হাদিস পেলেই বর্ণনা করার যে প্রবণতা দেখা যায়, তা পরিহার করা উচিত। আবু কাতাদা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-কে এই মিম্বারের ওপর কথা বলতে শুনেছি যে ‘আমার থেকে অধিক হারে হাদিস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকো। আর যে হাদিস বর্ণনা করতে চাও সে যেন সত্য ও সঠিক হাদিস বলে। আর যে আমার ব্যাপারে এমন কথা বলবে, যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২৬৭৬৮)

২. দুর্বল হাদিসের ব্যাপারে প্রান্তিকতা পরিহার : জয়িফ বা দুর্বল হাদিস নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রান্তিকতা রয়েছে। কেউ মনে করে জাল ও দুর্বল হাদিস এক। অথচ এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান আছে। জাল তো হাদিসই নয়, বরং মিথ্যুকরা একে হাদিস নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। আর জয়িফ অর্থ হলো বিবরণটির সনদে কিছু দুর্বলতা আছে, তবে এর কারণে বর্ণনাকে ভিত্তিহীন বলা যায় না। উসুলে হাদিসের নির্ভরযোগ্য মূলনীতি হলো জয়িফ দুই প্রকার। তা হলো—

এক. দুর্বল সনদে বর্ণিত এবং বর্ণনার বক্তব্য শরিয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। অর্থাৎ এই বক্তব্যের অনুকূলে শরিয়তের কোনো দলিল নেই, বরং এর বিপরীত দলিল রয়েছে। এমন দুর্বল হাদিস কোনো অবস্থায়ই আমলযোগ্য নয়।

দুই. রেওয়াতটি জয়িফ সনদে বর্ণিত; কিন্তু তার বক্তব্যের সমর্থনে শরিয়তের অন্য দলিল-প্রমাণ রয়েছে। মুহাক্কিক মুহাদ্দিস ও ফকিহদের সিদ্ধান্ত হলো, এ ধরনের বর্ণনা সনদের বিবেচনায় দুর্বল হলেও বক্তব্য ও মর্মের বিচারে তা সহিহ।

আর কেউ কেউ অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে, যেন এটা অধিক বিশুদ্ধ বর্ণনা। তাদের ওপর দুঃখ প্রকাশ করে মাওলানা আবদুল মালেক বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় আলোচনাসভা, এমনকি উলামায়ে কিরামের আত্মশুদ্ধিমূলক বিশেষ মজলিসেও অগ্রহণযোগ্য, দুর্বল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তা অধিকতর বিশুদ্ধ! তাদের এই আচরণের ওপর লজ্জিত হোন এবং (যদি সম্ভব হয়) রক্তমিশ্রিত চোখের পানি ফেলুন।’ (আল-মাদখাল ইলা উলুমিল হাদিসিস শরিফ, পৃষ্ঠা ১৫-১৬)

৩. লোকমুখে প্রচলিত বর্ণনার ব্যাপারে সতর্কতা : অনলাইন-অফলাইন, বই-পুস্তক, ধর্মীয় সভা-সমাবেশ এবং দেশের ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ভিত্তিহীন বর্ণনা ও লোকমুখে প্রসিদ্ধ ঘটনার ব্যাপক প্রচার হয়ে থাকে। যে লিখছে বা বলছে, সে নিজেও জানে না এটা কোথায় আছে বা এর কোনো ভিত্তি আছে কি না! অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শোনে, তা-ই বর্ণনা করে দেয়।’ (মুকাদ্দিমা সহিহ মুসলিম, পৃষ্ঠা ৭)

৪. উদ্ধৃতির প্রতি গুরুত্বারোপ : জাল বা ভিত্তিহীন বর্ণনার প্রচার রোধে মূল কিতাব দেখা এবং উদ্ধৃতি বা রেফারেন্স যাচাইয়ের বিকল্প নেই। কেননা এসবের প্রতি অবহেলার কারণে সমাজে ভিত্তিহীন বর্ণনার ব্যাপক প্রচার ঘটছে। মনে রাখতে হবে, রেফারেন্স বা উদ্ধৃতি কেবল স্থান নির্দেশক। যদি তা সঠিক হয়, তাহলে শুধু এতটুকু প্রমাণিত হবে যে উদ্ধৃত কিতাবের নির্দিষ্ট স্থানে হাদিসটি বিদ্যমান আছে। তারপর যদি উদ্ধৃত কিতাবে হাদিসটি বিশুদ্ধ সনদে থাকে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়।

হাদিস বর্ণনায় সাহাবিদের সতর্কতা : আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার বাবা জুবায়েরকে বললাম, আমি তো আপনাকে অমুক অমুকের মতো আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর হাদিস বর্ণনা করতে শুনি না। তিনি বলেন, ‘জেনে রাখো, আমি তাঁর থেকে দূরে থাকিনি; কিন্তু আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যে আমার ওপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেবে (এ জন্য হাদিস বর্ণনা করি না)।’ (বুখারি, হাদিস : ১০৭)

তাই হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে সবাইকে আরো সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ।

আপনার মতামত জানান