বৈশাখে ঋদ্ধ করি প্রাণ
মোগল সম্রাট আকবর উপলব্ধি করেন, চান্দ্রমাসনির্ভর হিজরি সনের আলোকে রাজস্ব ও খাজনা আদায় ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই রাজস্ব আদায়ে শৃঙ্খলা অর্জনের জন্য প্রবর্তন করেন সৌর সন কিংবা গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জিভিত্তিক বঙ্গাব্দের।
গবেষক শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মোগল সুবেদার মুর্শিদ কুলি খান আকবরের রাজস্বনীতি গ্রহণ করে ‘পুণ্যাহ’-এর রীতি উদ্ভব করে এই দিনটির সঙ্গে উৎসবের যোগসূত্র ঘটান। বাংলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে ব্যবসারও যোগ ঘটে হালখাতার হিসাব মিলিয়ে নতুন খাতা খোলার, ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়নের, যা আজও বিশেষ করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচলিত।
১৯৭৫ সালে কলকাতা ভ্রমণে গিয়ে কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকানে এটি সীমাবদ্ধ মনে হয়েছে। তবে ধারণা করি, বর্তমানে বাংলাদেশের অনুসরণে পশ্চিমবঙ্গের নগরজীবনে সাংস্কৃতিক আয়োজনের প্রচলন হয়েছে।
অবশ্য এই অঞ্চলে বহু বছর ধরে কয়েকটি গ্রাম মিলে একটি এলাকায় নববর্ষকে উপলক্ষ করে বৈশাখী মেলার সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে পল্লীর জনগোষ্ঠীর কৃষি ও সংস্কৃতির একটা নিবিড় যোগাযোগ ও কেন্দ্রীয় উৎসবের রূপ লক্ষ করা গেছে। এসব গ্রামীণ জনপদের মানুষের খুব ভোরে নতুন জামা-কাপড় পরে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। অবশ্য শেষ গন্তব্য বেশির ভাগ লোকেরই গ্রামীণ মেলায়। বহুক্ষেত্রে যুক্ত হয় নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা ও কুস্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখকে সমন্বিত করে বৈসাবি উৎসব অদ্যাবধি উদযাপিত হয়। অবশ্য গত কয়েক দশকে দ্রুত নগরায়ণের ফলে এই গ্রামীণ সংস্কৃতির আদি ধারাটি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নগরজীবনে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে বাংলা নববর্ষ এসেছে নুতন পটভূমিতে, সম্পূর্ণ নুতন অবয়বে সূদুরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে। পাকিস্তানের শাসকবর্গ ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির দুটি অঞ্চলকে অভিন্ন ধর্মের বাঁধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে আমাদের বাঙালি জাতি পরিচয় বিস্মৃত করে কেবল ধর্মপরিচয়ে পরিচিত করার জন্য প্রথম আঘাত হানে ভাষার ওপর। এবং ধারাবাহিকভাবে বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ওপর। সন্জীদা খাতুন জানিয়েছেন, বাঙালি জাতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করার ব্রত নিয়ে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে যে ছায়ানটের জন্ম হয়েছিল, শিল্পী সৃষ্টির তাগিদ থেকে ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল অবধি তৎকালীন ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন যখন আস্তানা লাভ করে ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে (বর্তমানে উদয়ন স্কুলে) তখন নববর্ষ উদযাপিত হয় সেখানে সীমিত পরিসরে।
বৃহত্তর পরিসরে ছায়ানট ১৯৬৭ সালে নববর্ষে সংগীতের আবহে নগরজীবনে বাঙালির মিলনমেলা সৃষ্টির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে রমনার বটমূলে নববর্ষের নাগরিক আয়োজনের। স্মরণে আনা দরকার, বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে লাহোরে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন এবং আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে অনুমোদনের পর মধ্য এপ্রিল থেকে ছয় দফা প্রচার অভিযানে সক্রিয় হন। পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ও জনগণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে মূলধারার আন্দোলন গড়ে তুলেছে, ষাটের দশকে তার সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়েছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।
এটি লক্ষণীয় যে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যতটা বেগবান হয়েছে, আমরা ছায়ানটের কর্মীরা লক্ষ করেছি যে রমনার বটমূলের আয়োজনে লোকসংখ্যা ততটা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম দুই বছর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর শ্রোতা-দর্শকদের সঙ্গে আমাদের শুভেচ্ছা বিনিময় সহজ হতো। সত্তরের পর সেটি আর সম্ভব হয়নি, রমনার বটমূল প্রাঙ্গণে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তাই পাকিস্তান আমলে বাঙালি জীবনে নববর্ষ এসেছে মূলধারার বাঙালি স্বাধিকার সংগ্রামের অনুষঙ্গ হয়ে, নতুন বার্তা নিয়ে, সর্বজনের হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণের আহ্বান নিয়ে। নববর্ষের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এটি নয় কোনো রাজস্ব আদায় কিংবা বাণিজ্যিক আয়োজন। নববর্ষের অনুষ্ঠান বাঙালি জীবনে এসেছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যুগলবন্দিতে জাগরণের আহ্বান নিয়ে। এটি সার্বিকভাবে ছিল সর্বজনের হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তার উন্মোচন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার পর বাঙালির সংস্কৃতির যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন হয়েছে, সংগীতচর্চার প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেয়েছে, সংগীত, নৃত্যকলা ও চিত্রকলায় বিদেশে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, মঞ্চনাটকের বিকাশ চমকপ্রদ, বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের প্রসার ঘটেছে। ফলে সংগীতের মধ্য দিয়ে নববর্ষকে আবাহন ঢাকা মহানগরীতে সীমাবদ্ধ নয়, প্রতিটি জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামাঞ্চলে নববর্ষের সাংগীতিক আয়োজন লক্ষ করা যায়। এটি বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসব। সামর্থ্য অনুযায়ী সবাই নতুন পোশাকে নিজেকে প্রকাশ করে, উন্নতমানের খাদ্য গ্রহণ করে।
১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে সর্বসাধারণ যোগ দেয়। এই আয়োজন ইউনেসকোর মানবতাবাদী আহ্বানের বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ছায়ানটের রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে প্রচার ও সর্বশেষে নববর্ষের বোনাস দেশব্যাপী এই অনুষ্ঠানমালাকে জাতীয় ঐতিহ্যের অংশে পরিণত করেছে। নববর্ষ প্রচলনের ইতিহাসের সঙ্গে এটি সম্পর্কহীন। নববর্ষকে নিয়ে বাণিজ্যিক আয়োজন চলে বটে, তবে গভীরে এটি পরিণত হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসব।
তবে মৌলিক কিছু সমস্যা নতুন অবয়বে আবির্ভূত হয়েছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। ফলে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান লক্ষ করা যায়। আর গত কয়েক দশকে বিশ্বজুড়ে এবং উপমহাদেশে ধর্মবিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ধর্মের মর্মবাণীকে উপেক্ষা করে তার উগ্রবাদী ব্যাখ্যা কিছু মানুষের মনোজগতে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রতিজনের জন্মসূত্রে নানা পরিচয় থাকে ধর্ম পরিচয়, জাতি পরিচয়, এমনকি আঞ্চলিক পরিচয়। এদের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই এবং সংস্কৃতি জাতি পরিচয়ের অন্যতম প্রধান নির্ধারক। কিন্তু এই অপশক্তি পাকিস্তান আমলের মতো আমাদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জাতিসত্তার যে বীজ নববর্ষের আয়োজনে বপন হয়েছে, তার মধ্যে সংঘাত কল্পনা করে আত্মপরিচয়ের সংকট সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছে। এ ভ্রান্ত ধারণা সমাজের ওপরে যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে বিষয়ে সবার সজাগ থাকা প্রয়োজন।
বিগত দুটি বছরে অতিমারির কারণে আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় ও স্বজন হারানোর বেদনায় আমরা গৃহবন্দি ছিলাম। যার ফলে প্রচলিত ধারায় নগরজীবনে নববর্ষের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এ বছর দুঃসময় অতিক্রম করে পুনরায় বাঙালির মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। নতুন বছর সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক। শুভ নববর্ষ।
লেখক: নির্বাহী সভাপতি, ছায়ানট
সুত্র: কালের কন্ঠ
আপনার মতামত জানান