বিসিএসে কেন এত আগ্রহ

প্রকাশিত

করোনার ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও ‘রেকর্ডসংখ্যক’ পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণে কয়েক দিন আগে বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে গেল। পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণে এ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে গতবারের পরীক্ষার্থীর সংখ্যাকে।

গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তার আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। খুব সাধারণ কিছু হিসাব-নিকাশ বলে দেয় এ ট্রেন্ড বজায় থাকবে। তাই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আগামী দিনগুলোতেও বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হবে।

বিসিএস নিয়ে এখন যা চলছে, সেটা বেশ কিছুদিন থেকেই আর আগ্রহের পর্যায়ে নেই, নেই হুজুগের পর্যায়েও-এটি পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর প্রবণতায়। দেশের জনসংখ্যার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বিসিএস নামক এ মরীচিকার পেছনে ছুটছে। এটা আসলে মরীচিকাই-এবার যখন পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে তখন শূন্যপদের সংখ্যা মাত্র ২১০০-এর মতো।

গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকে বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত ৬-৭ বছর তরুণরা বিসিএস পরীক্ষার পড়া ছাড়া আর কিছুই করছে না। এখন আবার এ দাবিও উঠে আসছে-বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার বয়সসীমা ৩৫ বছর করতে হবে। অর্থাৎ তরুণরা তখন দীর্ঘ এক যুগ বিসিএস নামের মরীচিকার পেছনে ছুটবে।

আগের অনুচ্ছেদে যে লিখেছি ‘গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকে’, সেটাও বেশ কিছুদিন থেকে আর সঠিক তথ্য নয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ুয়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাদের পড়াশোনার মূল বিষয় বাদ দিয়ে বিসিএসের পড়াশোনায় ব্যস্ত। ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের পড়ার টেবিলে তাদের মূল পড়াশোনার বইয়ের চেয়ে বেশি দেখা যায় বিসিএস প্রস্তুতির বই।

এ দেশে বিসিএস পরীক্ষার যে স্ট্রাকচার, তাতে সেটা মেধাকে মূল্যায়ন করে না, করে কিছু মুখস্থ বিদ্যাকে; তাই সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যকার বিষয় বলে মনে করে একেবারে মেধাহীন ছাত্রছাত্রীরাও। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে এক দশকের মতো সময় ব্যয় করছে বিসিএসের পেছনে।

না এখানেও শেষ হয়নি, ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম চেয়ে একটা আন্দোলন চলছে গত কয়েক বছর ধরে। এ নিয়মটা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে বিসিএস নামের মরীচিকার পেছনে ছোটার সময়টা কত হবে? আর তাতে কতটা মাশুল দিতে হবে ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের কিংবা এ জাতিকে?

এ দেশের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী তাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটা বড় অংশ এভাবে অপচয় করছে বিসিএসের পেছনে ছুটে। এমনকি যখন তাদের বয়স শেষ হয়ে যায়, তখন দেখা যায় তারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনায় তেমন উল্লেখযোগ্য দক্ষতা নিয়ে বেরোতে পারেনি। শিক্ষার নিচু মান আমাদের চিরকালীন সমস্যা।

তবে এ পর্যায়ে পড়ার সময়ে বিসিএস নিয়ে মূল ফোকাস রাখতে গিয়ে তাদের দক্ষতা পড়ে যায় আরও তলানিতে। বিসিএস বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, এটা সত্যি। তবে বিসিএসের প্রতি অতিআগ্রহকে একটা উপসর্গ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেটি আসলে বেশ জটিল কিছু ‘রোগ’ থেকে তৈরি হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-

১. দেশে শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের অবস্থা ভয়াবহ। অর্থনীতিবিদরা অনেক বছর থেকেই বলছিলেন, বাংলাদেশে ‘জবলেস গ্রোথ’ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী ২০১৮ সালে এটা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘দেশে একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি।’

দেশে শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে করোনা শুরু হওয়ার তিন মাস আগে। সেই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩.৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮.১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। অর্থাৎ দেশের অর্ধেকেরও কম শিক্ষিত তরুণ পূর্ণকালীন কাজে আছে। বিসিএস নিয়ে এ প্রবণতা দেশের বেকার সমস্যার এক উপসর্গ।

২. বলা হচ্ছে, সরকার যখন সরকারি চাকরির বেতন এক দফায় স্রেফ দ্বিগুণ করে দেয়, তখন থেকে বিসিএসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেছে। কথাটা ঠিক নয়, বিসিএসের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বেতন দ্বিগুণ হওয়ারও অনেক আগে। এ বেকারের দেশে বেতন দ্বিগুণ না হলেই বা কী, বিসিএসের পেছনে সবাই দৌড়াতোই। আছে আরও অনেক বড় ব্যাপার; সেখানে আসছি পরে।

বেতন ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তাদের আছে নানা রকম সুবিধা। সরকারি প্রাপ্য গাড়ি, প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার, মূল্যের ক্ষুদ্র একটা অংশ পরিশোধ সাপেক্ষে নিজস্ব গাড়ি কেনা, হোম লোন, পেনশন। আছে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ। পুকুর খনন শেখা, লিফট কেনা, টেংরা-পাবদার মতো দেশি মাছ চাষ, মৌমাছির চাষ শেখা, শহিদদের সম্মান জানাতে শেখার মতো অনেক (অ)কাজে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ।

৩. এ দেশের সংবিধান, আইন-এসব ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণি নির্বিশেষে সব নাগরিকের সম-অধিকার আর মর্যাদার কথা বলে; কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দাপট ছাড়া এ দেশে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা যায় না। দেশে দাপট তৈরি হয় যদি কেউ ক্ষমতাসীন দলের অংশ হতে পারে, অথবা হতে পারে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা (আমাদের সংবিধানে কর্মকর্তা বলে কিছু নেই যদিও)। সরকার প্রশাসনের ওপর যত বেশি নির্ভরশীল হবে, আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাও তত বেশি চলে যাবে তার সাংবিধানিক ও আইনি চৌহদ্দির বাইরে। এমন অতি ক্ষমতাশালী আমলাতন্ত্রের অংশ হতে কে না চাইবে?

৪. সব সরকারি চাকরির প্রতি যে আগ্রহ অনেক বেড়েছে তা নয়। আগ্রহ কিছু কিছু ক্যাডারকেন্দ্রিক। ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদদের মতো মানুষের জন্য বিশেষায়িত ক্যাডার থাকলেও তারা পুলিশ, প্রশাসন, আয়কর, কাস্টমসের মতো ক্যাডারে যোগ দেওয়ার জন্য লড়াই করছে। প্রথম শ্রেণির চাকরি পাওয়া নানা ক্যাডারের কর্মকর্তারাও চাকরি করতে করতে বিশেষ কিছু ক্যাডার প্রাপ্তির জন্য বয়স থাকা পর্যন্ত বারবার বিসিএস পরীক্ষা দিতে থাকেন। সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা উচিত-অর্থনীতি বলে বিসিএস একটি ক্যাডার ছিল, যেটি অতি সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারে বিলুপ্ত হয়েছে তাদের নিজেদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। অর্থাৎ দাপট, অর্থ চাইছেন সবাই।

৫. লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট। সরকারি চাকরিতে থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিরাট উপার্জনের সুযোগ। সবাই না হলেও একটি বড় অংশের সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আমি জানি, এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে গলা চড়িয়ে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে যাবে অনেকেই। কিন্তু আমরা এ দেশের সন্তান, থাকি এই দেশে আর বিসিএস কর্মকর্তাও একেবারে ‘দুষ্প্রাপ্য’ নন; বন্ধু, স্বজন ও পরিচিতদের মধ্যে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা আমাদের অনেকেরই আছে। তাই আমরা জানি, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের দেশে কী ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের খানা জরিপ বলছে, শুধু দৈনন্দিন কাজে? মানুষ সরকারি সেবা নিতে গিয়ে বছরে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা ঘুস দেয়। আর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে হওয়া দুর্নীতির পরিমাণ হবে এর কয়েক গুণ, যার এক উল্লেখযোগ্য হিস্যা থাকে সরকারি কর্মকর্তাদের।

বিসিএস ব্যাধি বাড়ছে তীব্রতায় ও ব্যাপ্তিতে। দেশের নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম জনশক্তির উচ্চ অনুপাতের সময়কাল ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে’র সময় এ ব্যাধি আমাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করবে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামাতে আমরা দেখি না। সংকটের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া তো হয়ই না, সংকট বীভৎস রূপ নিলেও সেটা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের নিস্পৃহতা নিশ্চিতভাবেই ক্ষমার অযোগ্য ব্যাপার।

সূত্রঃ যুগান্তর

আপনার মতামত জানান