বিনিয়োগের প্রকৃতি ও নীতি

প্রকাশিত



ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ‘মুদারাবা’ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। ‘মুদারাবা’ আরবি ‘দারব’ শব্দমূল থেকে এসেছে। এর অর্থ প্রহার করা, আঘাত করা, অন্বেষণ করা, দৃষ্টান্ত দেওয়া, পরিভ্রমণ করা ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে শব্দটি পরিভ্রমণ করা অর্থে একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।

এক আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘…অন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করে…(আংশিক)। ’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ২০)

আলোচ্য আয়াতে সাহাবায়ে কেরামের ব্যাবসায়িক ভ্রমণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুদারাবার ভিত্তি হিসেবে উল্লিখিত আয়াত উপস্থাপন করা হয়। উদ্যোক্তা বা শ্রম বিনিয়োগকারী যেহেতু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে গমন করে, তাই এর নাম ‘মুদারাবা’।

মুদারাবার আরেকটি নাম ‘মুকারাজা’ বা ‘কিরাজ’। এর অর্থ পৃথক করা, বিচ্ছিন্ন করা। যেহেতু পুঁজিদাতা তার সম্পদের একটি অংশ ব্যবসায়ীর জন্য পৃথক করে তাই এটাকে ‘মুকারাজা’ বা ‘কিরাজ’ বলা হয়। তবে এ নামের প্রচলন আগে থাকলেও এখন আর নেই।

তুরস্কে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উসমানি খেলাফতের অধীনে রচিত ‘ইসলামী বিধিবদ্ধ আইন’-এর ১৪০৪ ধারায় মুদারাবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মুদারাবা এক ধরনের অংশীদারি ব্যবসা। এতে এই মর্মে চুক্তি করা হয় যে একপক্ষ মূলধন জোগান দেবে আর অন্যপক্ষ ব্যবসার উদ্দেশ্যে শ্রম দেবে। মূলধন জোগানদাতাকে ‘রাব্বুল মাল’ বলা হয়, আর শ্রমদাতাকে ‘মুদারিব’ বলা হয়।

‘সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ’ কর্তৃক প্রণীত ‘ইসলামী ব্যাংক কম্পানি আইন’-এ মুদারাবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মুদারাবা এমন এক ব্যাবসায়িক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, যার মধ্যে একপক্ষ মূলধন জোগান দেবে এবং অন্যপক্ষ তার দক্ষতা, শ্রম ও প্রচেষ্টা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করবে। মূলধন সরবরাহকারীকে ‘সাহিবুল মাল’ বা পুঁজিপতি এবং ব্যবহারকারীকে ‘মুদারিব’ বা উদ্যোক্তা বলা হয়। প্রাপ্ত মুনাফা চুক্তি মোতাবেক উভয়পক্ষে বণ্টিত হবে। লোকসান হলে তা সাহিবুল মাল বহন করবে। তবে সেই ক্ষতি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে হলে মুদারিবকে ক্ষতির দায় নিতে হবে। সাহিবুল মাল কোনোভাবেই ব্যবসায় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না। ’ [ইসলামী ব্যাংকস, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড জার্নাল, প্রথম সংখ্যা, মার্চ ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৩৪ (পরিমার্জিত)]

ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সংজ্ঞা মতে :

Mudaraba is a form of partnarship where one party (sahib al maal/Rabbul maal) provides the fund while the other provides expertise and managemant. The latter is reffered to as the Mudarib (Manager). Any profet accrued isshared between the two parties on a pre-agreed basis, while capital loss is exclusively borne by the partner providing the capital (sahib al mal)

মুদারাবা বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্য

মুদারাবা বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্য হলো, মুদারাবা কারবারে এক পক্ষের পুঁজি, অন্য পক্ষের শ্রম। লাভ হলে চুক্তিসম্মত হারে ভাগ করে নেবে। লোকসান হলে তা পুঁজির মালিকের। তবে সেই ক্ষতি মুদারিব (উদ্যোক্তা) কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে হলে মুদারিবকে ক্ষতির দায় নিতে হবে। কারবার শেষে চুক্তি নবায়ন না হলে তা আপনা-আপনি বাতিল হয়ে যাবে। মুদারাবার মূলধন নগদ বা স্বর্ণ হতে হবে। মূলধনের পরিমাণ-প্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

মুদারাবা বিনিয়োগে পার্সেন্টিস নির্ধারণ করা বৈধ। পার্সেন্টিস হিসেবে যতটুকু উভয় চুক্তিকারী সম্মত হয়, ততটুকু মুনাফা গ্রহণই জায়েজ আছে। এখানে কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই। কিন্তু মুনাফার পার্সেন্ট উভয় চুক্তিকারীর সম্মতিক্রমে হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে মুনাফার হার সমান হওয়া জরুরি নয়। কিন্তু মুনাফার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বা বস্তু নির্দিষ্ট করা বৈধ নয়।

মুনাফা চুক্তির একটি উদাহরণ হলো—টাকা প্রদানকারী এ কথা বলল যে লাভের ৫০/৬০/৭০ পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে। এতে উভয় চুক্তিকারী সম্মত হলো। তাহলে চুক্তিকৃত মুনাফা অর্থদাতা পাবে, আর বাকিটা পাবে মুদারিব। কিন্তু যদি এ কথা বলে যে লভ্যাংশ থেকে ৫ হাজার টাকা আমাকে দিতে হবে। অর্থাৎ পার্সেন্টিস নির্দিষ্ট না করে পরিমাণ নির্দিষ্ট করে, তাহলে উক্ত চুক্তি বৈধ হবে না।

আর চুক্তির সময় মুনাফার হার উল্লেখ করলে অর্ধার্ধিহারে মুনাফা বণ্টন করা হবে। (মাওলানা ইমরান আশরাফ ওসমানি, ব্যাংকিং ও আধুনিক ব্যবসা-বাণ্যিজের ইসলামী রূপরেখা, মাদানী কুতুবখানা, প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০০৭, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৭১)

মুদারাবার প্রকারভেদ

চুক্তির ভিত্তিতে মুদারাবা বিনিয়োগ দুই প্রকার। যথা :

১. মুদারাবা মুতলাকা বা সাধারণ মুদারাবা। যে মুদারাবা ব্যবসায় মুদারিবকে কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করা ছাড়া সাহিবুল মাল কর্তৃক ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাকে আল-মুদারাবাতুল মুতলাকাহ বা সাধারণ মুদারাবা বলা হয়।

২. মুদারাবা মুকাইয়াদা বা বিশেষ মুদারাবা। যে মুদারাবা ব্যবসায় সাহিবুল মাল ব্যবসার ধরন, মেয়াদ, স্থান ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দেয়, তাকে আল-মুদারাবা আল-মুকাইয়াদা বা বিশেষ মুদারাবা বলা হয়।

মুদারাবা সমাপ্ত করা

মুদারাবা চুক্তি উভয় পক্ষের সম্মতিতে সমাপ্ত করতে পারে। প্রশ্ন হলো, মুদারাবাকে এমন কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদের সঙ্গে নির্ধারণ করা যাবে কি না, যে মেয়াদ অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুদারাবা চুক্তি নিজে নিজেই সমাপ্ত হয়ে যাবে। হানাফি ও হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী, মুদারাবাকে সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করা যাবে। যেমন—এক বছর, ছয় মাস ইত্যাদি। এরপর মুদারাবা বিনা নোটিশে সমাপ্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে মালেকি ও শাফেয়ি ফিকহবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো মুদারাবাকে নির্দিষ্ট মেয়াদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করা যাবে না।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে মুদারাবা

মুহাম্মদ শামসুল হুদা ও মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা রচিত এক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকগুলোতে মুদারাবা পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে অনুশীলিত হলেও সমাজে সততা ও নৈতিকতার অভাবসহ আরো কিছু বাস্তব সমস্যার কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর অনুশীলন এখনো সীমিত রয়েছে। (‘ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি শরীআহর নীতিমালা, পৃষ্ঠা ১৩১)

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর নিজস্ব শরিয়া বোর্ড আছে। তথাপি কেউ এটা দাবি করেনি যে এসব ব্যাংকে শতভাগ বিশুদ্ধভাবে শরিয়া প্রতিপালিত হয়। তবে হ্যাঁ, সবাই শরিয়া প্রতিপালনের চেষ্টা করছে, এটা সাধুবাদযোগ্য। সুতরাং শরিয়া লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত থাকা স্বাভাবিক। আর শরিয়া লঙ্ঘনের বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন—ক. সমাজ ও দেশের সুদি পরিবেশ। খ. ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব। গ. কমিটমেন্টের ঘাটতি। ঘ. যেনতেনভাবে মুনাফা অর্জনের প্রবণতা। ঙ. আখিরাতে জবাবদিহির দুর্বল অনুভূতি।

তবু ইসলামী ব্যাংকগুলো সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সত্যিকার অর্থে শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত হোক—এটাই প্রত্যাশা।

আপনার মতামত জানান