ফুসফুসের ক্যান্সার
ফুসফুসের শ্বাসনালি, বায়ুথলি ও মিউকাস গ্ল্যান্ডের এপিথেলিয়াম কোষ থেকে সৃষ্ট ক্যান্সার হলো ফুসফুসের ক্যান্সার বা ব্রংকোজেনিক কারসিনোমা। বিশ্বব্যাপী পুরুষের মৃত্যুর প্রথম কারণ ফুসফুসের ক্যান্সার, আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয় কারণ।
এই রোগ গ্রামের চেয়ে শহরবাসীর বেশি হয়। পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ৮০ ভাগ ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীই ধূমপানের শিকার।
শ্রেণিবিভাগ
ক্যান্সার কোষের ওপর নির্ভর করে ফুসফুসের ক্যান্সারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন স্মল ও নন-স্মল সেল। ফুসফুসের ক্যান্সার চিকিৎসার ভিত্তি এই হিসটোপ্যাথলজিক্যাল শ্রেণিবিভাগ। স্মল সেল ২০ ভাগে বিভক্ত। আর নন-স্মল সেলে তিনটি ভাগ হলো : স্কোয়ামাস (৩৫ শতাংশ), এডেনোকারসিনোমা (৩০ শতাংশ), লার্জ সেল (১৫ শতাংশ)।
কারণ
পরিবেশগত কারণ ও লাইফস্টাইল সম্পর্কিত বেশ কিছু উপাদানে ফুসফুস ক্যান্সারের উৎপত্তি হয়। ফুসফুস ক্যান্সারের কারণগুলো হলো—
ধূমপান : ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য ধূমপান হলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান দুটিই ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ফুসফুসের সব ধরনের ক্যান্সার রোগীর ৯০ শতাংশই ধূমপায়ী। আর ৫ শতাংশ পরোক্ষ ধূমপায়ী ক্যান্সারে ভোগে। দিনে ২০টি করে ৪০ বছর সিগারেট খেলে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীর তুলনায় ২০ গুণ বেশি হয়। ধূমপান ত্যাগ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সে ধূমপান ত্যাগে সবচেয়ে ভালো সুফল পাওয়া যায়।
বায়ুদূষণ : অজৈব পদার্থের ক্ষুদ্র কণা বা আঁশ যেমন : এসবেস্টস, নিকেল, ক্রোমিয়াম এবং জৈব পদার্থ যেমন : বেনজিন, বেনজোপাইরিন বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
তেজস্ক্রিয়তা : ক্যান্সার চিকিৎসায় যে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়, তার তেজস্ক্রিয়তায় ক্যান্সার রোগী দ্বিতীয়বার ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। বায়ুতে রোডন নামের গ্যাসেও তেজস্ক্রিয়তা থাকে। এটি ধূমপানের পরে ফুসফুসে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
খাদ্যাভ্যাস : অতিরিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার এই ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
অন্যান্য রোগ : সিওপিডি, যক্ষ্মা, সিলিকসিস, আইএলডি রোগগুলোতে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
জেনেটিক বা বংশগত : ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীর আত্মীয়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। ধারণা করা হয়, ক্যান্সার রোগের উৎপত্তিতে বংশগত প্রভাব বিদ্যমান।
উৎপত্তি
এই ক্যান্সারের উৎপত্তি অন্যান্য ক্যান্সারের মতোই। প্রথম ক্যান্সার সহায়ক অনকোজিন সক্রিয় হয় অথবা ক্যান্সার দমনকারী জিন নিষ্ক্রিয় থাকার ফলে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জিনে পরিবর্তিত হয়, যা ক্যান্সার উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখে। সাধারণত শ্বাসনালির গোড়ার দিকে স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা আর মাঝখানে স্মল সেল কারসিনোমা উৎপন্ন হয়।
লক্ষণ
নানা রকমের লক্ষণ আছে, যা দেখে কিছুটা ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। যেমন—
♦ ৫০-৭০ শতাংশ রোগীরই কাশি হয়, বিশেষ করে শুষ্ক কাশি। কোনো ধূমপায়ীর দীর্ঘমেয়াদি কাশি হলে ক্যান্সার সন্দেহ করা উচিত।
♦ ২০-৫০ শতাংশ রোগীর কাশির সঙ্গে রক্ত যায়। রক্তের পরিমাণ বেশি হলে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে রোগীর দেহে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, যাকে বলে ‘এসফাইক্সিয়া’।
♦ বুকের মাঝখানে (ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানে) স্থায়ী, তবে মৃদু ব্যথা হয়।
♦ শ্বাসনালিতে বাধা পায় বা ডায়াফ্রাম অবশ হয়ে শ্বাসকষ্ট হয়।
♦ রিকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল নার্ভে ফুসফুসের ক্যান্সার বিস্তৃত হয়ে কণ্ঠস্বর বদলে যায়।
♦ ফুসফুসের বাইরের পর্দায় পানি জমা হয়। সাধারণত ক্যান্সারে এই পানি রক্ত বর্ণের হয়।
♦ মস্তিষ্ক, লিভার, হাড়সহ নানা অঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সার বিস্তৃৃত হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
এক্স-রে : ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এক্স-রে। যেকোনো ব্যক্তির, বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্ব, ধূমপায়ীর দীর্ঘমেয়াদি কাশি হলে অবশ্যই এক্স-রে করা উচিত।
শ্লেষ্মার সাইটোলজি : রোগীর কফ বা শ্লেষ্মায় ক্যান্সার কোষ আছে কি না তা এই পরীক্ষায় জানা যায়।
বুকের সিটি স্ক্যান : এক্স-রের চেয়ে আরো সূক্ষ্মভাবে ফুসফুসের ক্ষত ধরা পড়ে সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে। ক্যান্সারটি কতটা বিস্তৃৃত, লিম্ফগ্ল্যান্ডে বিস্তৃত হয়েছে কি না—এ বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে জানা যায় এই পরীক্ষার সাহায্যে।
ব্রংকোসকপি : এই যন্ত্রের সাহায্যে শ্বাসনালি ভেতরের ক্যান্সার টিস্যুর বায়োপসি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। আবার ব্রংকোসকপির সঙ্গে আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্র যুক্ত করে শ্বাসনালির কাছের লিম্ফনোড থেকে রস নেওয়া যায়। এই পদ্ধতিকে বলে ইবাস (EBUS)।
সিটিচালিত এফএনএসি : যদি টিউমার ব্রংকোসকপিতে না পাওয়া যায়, তখন এই পরীক্ষার সাহায্যে ফুসফুসের ক্ষত থেকে রস নিয়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়।
পেট স্ক্যান : পেট স্ক্যান পরীক্ষা সাধারণ সিটি স্ক্যানের চেয়ে আরো সূক্ষ্ম। তবে টিবি রোগের জন্য পেট পজিটিভ রিপোর্ট দিতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থেকে পেট স্ক্যানের রিপোর্ট করতে হবে।
এ ছাড়া প্লুরাল ইফ্যুসান, লিম্ফনোড বায়োপসি ইত্যাদি নানা পরীক্ষায়ও ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় হয়।
চিকিৎসা
ফুসফুসে ক্যান্সার কোনো জীবাণুঘটিত রোগ নয়। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি থাকলেও এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। যদিও প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ শুরু করলে মোটামুটি আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।
সাধারণ ব্যবস্থা : প্রথম কাজ হলো, রোগীকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দেওয়া, ধূমপান বর্জনে যথাযথ চিকিৎসা প্রদানসহ অন্যান্য রোগের যথাযথ চিকিৎসা করা। সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি—সাধারণত ফুসফুস ক্যান্সারের এই তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। ক্যান্সারের হিস্টোপ্যাথোলজিক্যাল শ্রেণি ও পর্যায়ের ওপর চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে।
সার্জারি : স্কোয়ামাস ও অন্যান্য নন-স্মল সেল ক্যান্সারে প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়।
রেডিওথেরাপি : স্কোয়ামাস ও অন্যান্য নন-স্মল সেল ক্যান্সার যদি সার্জারির অযোগ্য হয়, তখন রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত রক্তকাশি, তীব্র হাড় ব্যথা, সুপিরিয়র ভেনা ক্যাভা শিরায় বাধা—এসবের উপশমে রেডিওথেরাপি বেশ কার্যকর।
কেমোথেরাপি : স্মল সেল ক্যান্সারের মূল চিকিৎসা কেমোথেরাপি। এর সঙ্গে রেডিওথেরাপি চিকিৎসাও যুক্ত হয়। এ ছাড়া নন-স্মল ক্যান্সারেও সার্জারির আগে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়।
প্রতিরোধে করণীয়
♦ সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা। খাবারের মেন্যুতে তাজা ফলমূল ও শাকসবজি নিয়মিত রাখা।
♦ ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধূমপান না করা।
♦ অধূমপায়ীরাও একেবারেই বিপদমুক্ত নয়। শিল্প-কারখানা ও গাড়ির নির্গত কালো ধোঁয়াও ফুসফুসে ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
♦ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন—ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি এড়িয়ে চলা। ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টিতে অ্যাসবেস্টসের প্রভাব এত বেশি যে সমসাময়িককালে জাহাজশিল্পে অ্যাসবেস্টসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
♦ ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ যেমন—যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া ভালো হওয়ার পর ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। তাই যথাসম্ভব সতর্ক থাকা।
♦ ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি যদি ৩০ বছরের বেশি প্রতিদিন ২০টির বেশি সিগারেটের ধূমপান করে, তাদের ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং করা উচিত। এভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি ধরা পড়লে চিকিৎসা দিয়ে মৃত্যুহার কমানো যায়।
তথ্যসুত্র : দৈনিক কালের কন্ঠ
আপনার মতামত জানান