প্রাণবন্ত লোকজ মেলায় নিষ্প্রাণ প্রদর্শনী
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রগাঢ় অনুরাগ, ধ্যান-জ্ঞানে ছিল লোকজ সংস্কৃতি। তিনি লোকফর্ম সংগ্রহ করে বাঙালির মৌলিক চর্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। লোক ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রতিবছর মাসব্যাপী লোকজ মেলার আয়োজন করা হয় ।
প্রতি বছরের মতো এবারও ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত সোনারগাঁয়ে শুরু হয়েছে লোকজ মেলা। মাসব্যাপী এই আয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘কর্মরত কারুশিল্পী প্রর্দশনী’ স্টলে দেশের প্রথিতযশা লোকশিল্পীরা তাদের কারুকাজ দিয়ে মেলার দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে অংশ নিয়ে থাকেন। এবারও ৪০টি স্টল ঐতিহ্যবাহী একেকটি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে শিল্পীরা। স্টলে স্টলে স্থান পেয়েছে মৃৎ, কাঁসা-পিতল, শঙ্খ, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, শোলাসহ বিলুপ্তপ্রায় নানা শিল্পের নিদর্শন। দীর্ঘসময় করনায় ঘরবন্ধী মানুষের আগমনে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে এ মেলা। কিন্তু মেলার ‘কর্মরত কারুশিল্পী প্রর্দশনী’ স্টলে দেশের নামকরা কারুশিল্পীদের স্থান না হওয়ায় প্রদর্শনী স্টলগুলোতে দর্শনার্থীরা অবলোকন করছে প্রাণবন্ত মেলায় নিস্প্রাণ প্রদর্শনী।
গতকাল সরেজমিন মেলার কর্মরত কারুশিল্পীদের প্রদর্শনী স্টলে গিয়ে দেখা যায়, অনেকগুলো স্টল বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে যারা কোন শিল্পকর্ম প্রদর্শন করতে অক্ষম। এদের অধিকাংশই অন্যের তৈরি শিল্পকর্ম কিনে এনে বিক্রি করছেন। ধাতব শিল্প, নকশীকাঁথা শিল্প, ঝিনুক শিল্প, পাটশিল্প ও বেত শিল্পের স্টল সহ আরো কয়েকটি স্টলে শিল্পীরা নিজেদের শিল্পকর্ম দেখাতে পারছেন না। তবে খুঁজে পাওয়া যায়নি দেশবিদেশ থেকে ৩৫টি সম্মাননা পুরস্কার পাওয়া রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি সুশান্ত কুমার পাল, দেশ বিদেশে ২৭টি সম্মাননা পুরস্কার পাওয়া এককাঠের ঘোড়া শিল্পের বীরেন্দ্র সূত্রধর ও আশুতোষ সূত্রধর, আশুতোষের স্ত্রী হাতপাখা শিল্পী সন্ধ্যা রানী, দেশ বিদেশে ৬৭টি সম্মাননা পুরস্কার পাওয়া দারুশিল্পী হাজি আউয়াল, বিখ্যাত বাঁশ ও বেত শিল্পী পরেশ চন্দ্র দাস, পুরস্কারপ্রাপ্ত ধাতব শিল্পী মানিক সরকার, সুচি শিল্পের বিখ্যাত নকশিকাঁথা শিল্পী হোসনেয়ারা বেগমকে। উল্লেখিত শিল্পীরা বিশে^র বিভিন্ন দেশে কারুশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার, তুলে ধরেছেন লাল সবুজের পতাকা। খুঁজে পাওয়া যায়নি একতারা শিল্প ও শিল্পী।
প্রদর্শনী স্টলে দেখা যায় কর্মরত শিল্পী কিশোরগঞ্জের সৈয়ালপাড়া গ্রামের আরতি রানী নরম মাটি টিপে অসংখ্য ছোট ছোট ফিগার গড়েছেন। নিখুঁত অবয়ব না হলেও রূপটা এত আদি ও অকৃত্রিম যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তিনি কাজ শিখেছেন মা রেণু রানী পালের কাছে। বাকুরার ঘোড়া, মিসরের মূর্তি, হিন্দু মিথলজির নানা চরিত্র গড়া তামা-পিতল-কাঁসা শিল্পের মানিক সরকারকে অনেকেই খুজেন।
দারুশিল্পী হাজী আউয়ালের ছেলে রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি আমার বাবার কাছ থেকে দারুশিল্পের কাজ শিখেছি। আমি কয়েকবার বিসিকের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী নির্বাচিত হয়েছি। আমি সরকারের মাধ্যমে চায়না, উজবেকিস্তান ও দিল্লীতে আমার শিল্পকর্ম প্রদর্শণ করে পুরস্কার পেয়েছি। তবে এ বছর আমাদের কেন কর্মরত কারুশিল্পের প্রদর্শনী স্টলে রাখা হয়নি তা ফাউন্ডেশনের কতৃপক্ষ ভাল জানেন।
লোকজ গানের জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র একাতারা শিল্পী আবুল হোসেন বলেন, লোকজ মেলায় একতারার প্রদর্শনী কেন রাখা হয়নি তা আমি জানি না। এ শিল্পের সাথে ৪০ বছর ধরে জড়িত।
মিশরের মমির আদলে তৈরি এক কাঠের পুতুল ও এক কাঠের ঘোড়া শিল্পী আশুতোষ সুত্রধর ও বীরেন্দ্র সুত্রধর, ধাতব শিল্পী মানিক সরকার, ঝিনুক শিল্পী অমল চন্দ্র বিশ^াস বলেন, লোক শিল্পীদের জীবনমান উন্নয়ণে বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন যদি কারুশিল্পীদের মূল্যায়ন না করে এবং নতুন শিল্পী তৈরি না করে তবে আমাদের সংস্কৃতি থেকে এ শিল্প চিরতরে হারিয়ে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কারু শিল্পীদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হওয়ায় নতুন প্রজন্মের অনেকেই এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
নরসিংদী থেকে মেলায় ঘুরতে আসা কামরুল হাসান বলেন, লোকজ মেলায় প্লাষ্টিকের পণ্য না থাকলে ডিজিটাল ফেস্টুন ব্যানার লোকজ মেলায় মানানসই নয়। এ মেলার প্রতিটি স্থানে শিল্পীর তুলির ছোঁয়া চাই। কর্মরত কারুশিল্পীদের স্টলে গিয়ে আশাহত হয়েছি। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে এসেছি কিভাবে এককাঠের ঘোড়া, পুতুল, একতারা তৈরি করে তা দেখাতে। কিন্তু কোন শিল্পীকেই শিল্পকর্ম প্রদর্শন করতে দেখতে পেলাম না।
মেলা প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহ বলেন, কারুশিল্পের প্রসার বাড়াতে এবং নতুন শিল্পীদের আগ্রহী করতে এ বছর পুরনো অনেক শিল্পীকেই কর্মরত কারুশিল্পী প্রদর্শনীতে স্টল বরাদ্ধ দেওয়া হয়নি। তবে তাদেরকে ফাউন্ডেশনের কারুপল্লীতে স্থায়ীভাবে ঘর দেওয়া হয়েছে। নিজের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করতেই যাদেরকে স্টল বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে তারা যদি তা না করে কিংবা না পারে তবে অবশ্যই ব্যবস্তা নেওয়া হবে। এ মেলার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো লোকায়ত জীবন ও শিল্পের কাছে গিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি করা।
আপনার মতামত জানান