পুলিশের অভিযানে তরুণীর মৃত্যু: অভিযোগের তির দুই পুলিশ কর্মকর্তার দিকে
রাজধানীর পল্লবীতে পুলিশের মাদক উদ্ধার অভিযানের সময় বৈশাখী আক্তার নামের এক তরুণীর মৃত্যুর ঘটনা মীমাংসার জন্য প্রভাবশালীদের দিয়ে চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, তারা মামলা করার প্রস্তুতি নিলেও পুলিশ মীমাংসার জন্য চাপ দিচ্ছে।
ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহির উদ্দিন আহম্মেদের বিরুদ্ধে মাদক উদ্ধারের নাটক সাজানোর অভিযোগ করেছেন বৈশাখীর মা। তিনি পুরো ঘটনার জন্য জহির ও এএসআই ফেরদাউস রহমানকে দায়ী করছেন। তবে জহির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পুলিশ বলছে, লাভলী ও তাঁর মেয়ে মাদক কারবারে জড়িত। ওই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বৈশাখী অপরাধী হলেও পুলিশের উচিত ছিল তার জীবন রক্ষা করা।’
পল্লবীর আদর্শ নগরের ১১ নম্বর রোডে লাভলী আক্তারের বাড়িতে গত ২৪ জুলাই রাত নয়টার দিকে মাদক উদ্ধার অভিযানে যায় পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত পৌনে ১১টার দিকে লাভলীকে আটক করে চারতলা থেকে নামিয়ে আনার সময় তাঁর ও তাঁর ছোট মেয়ে বৈশাখীর সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে মাকে না ছাড়লে বৈশাখী আত্মহত্যার হুমকি দেন। পরে পুলিশ লাভলীকে গাড়িতে ওঠানোর সময় তিনতলার একটি ঘরে বৈশাখীকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে স্বজন ও স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করে।
পুলিশের দাবি, ওই তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। তবে পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের মারধরে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। পরিবার তাঁর বয়স ১৭ বছর বললেও পুলিশের দাবি ১৯ বছর। কয়েক মাস আগে বৈশাখী এক যুবককে বিয়ে করেন। ঘটনার আগের দিন মায়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। জানা গেছে, ওই বাড়িতে অভিযানে নেতৃত্ব দেন পল্লবী থানার এসআই জহির। সঙ্গে ছিলেন একই থানার এএসআই ফেরদাউস রহমান, কনস্টেবল মোস্তফা, কনস্টেবল ইয়াসমিন এবং কথিত সোর্স মোশাররফ, ওয়াহিদ, হৃদয় ও তৌহিদ। স্থানীয়রা বলেছেন, ওই চার সোর্সই চিহ্নিত মাদক কারবারি। জহির প্রায় আড়াই বছর পল্লবী থানায় কর্মরত।
ওই রাতের ঘটনায় পুলিশ পল্লবী থানায় পুলিশের ওপর হামলা, মাদক ও অপমৃত্যুর অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা করেছে। মামলায় লাভলীকে আসামি করে পলাতক দেখানো হয়েছে। তবে তিনি নিজের বাড়িতেই আছেন।
সাইফুল মুজীব নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সাদাপোশাকে এসআই জহির, এএসআই ফেরদাউস ও চার সোর্স প্রথমে লাভলীর বাসায় যান। বাসায় লাভলী, তাঁর বড় মেয়ে চাঁদনী ও ছোট মেয়ে বৈশাখী ছিলেন। সোর্সরা বাসায় ঢুকেই বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে। তারাই কাগজে পেঁচানো ইয়াবা বের করে ওই বাসায় ছিল বলে দাবি করে। পরে লাভলীকে আটক করে থানায় নেওয়ার চেষ্টা করলে চাঁদনী ও বৈশাখী বাধা দেন। তাঁরা প্রতিবাদ করেন।
লাভলী আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘কয়েকজন সোর্সকে দিয়ে বাসায় মাদক রেখে সোর্সকে দিয়েই খুঁজে বের করানো হয়। এভাবে পুলিশ মাদক উদ্ধারের অভিযানের নাটক সাজায়। দারোগা জহির একসময় আমাকে দিয়ে মাদক ব্যবসা করাতেন। এখন করতে না চাওয়ায় এই নাটক করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে মারধর করলে প্রতিবাদ করে বৈশাখী। সে আত্মহত্যার হুমকি দেয়। এরপর বৈশাখীকে তিনতলার একটি ঘরে ঢুকিয়ে মারধর করে। মরে যাওয়ার পর ঝুলিয়ে রাখছে। সেদিন পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন জহির। তা না হলে হেরোইন ও ইয়াবা দিয়ে মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।’
লাভলীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসআই জহির। তিনি বলেন, সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। থানার অনুমতি নিয়েই তিনি টিম নিয়ে অভিযানে যান। ওই বাড়ির নিচে নারী পুলিশ ছিল। এই পরিবার মাদক কারবারি।
লাভলী ও তাঁর মেয়েদের বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা ছাড়াও মারামারির মামলা রয়েছে। বৈশাখীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল, এর আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
বৈশাখীর মৃত্যু নিয়ে পরিবার যাতে আর কোনো প্রতিবাদ বা মামলা না করে, সে জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের দিয়ে পুলিশ চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন লাভলীর ভাই সুজন। গত সোমবার তিনি বলেন, ‘এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে মীমাংসার চেষ্টা করছে। কিছু টাকা দিয়ে আমাদের বুঝ দিতে চায়। তবে আমরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ উত্তরাধিকারসূত্রে ওই বাড়ির মালিক তাঁরা চার ভাই ও দুই বোন।
মীমাংসার জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান মিয়া। তিনি বলেন, গাঁজা, ইয়াবাসহ লাভলীকে পুলিশ আটক করলে তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে বৈশাখী তিনতলায় গিয়ে গলায় ফাঁস দেয়। সে আত্মহত্যা করেছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।
পুলিশের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান ডিএমপির মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মাসুক মিয়া। কমিটির সদস্য পল্লবী জোনের এডিসি নাজমুল হাসান ফিরোজ বলেন, তদন্ত চলছে। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্ত শেষে বলা যাবে, পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি না।
আপনার মতামত জানান