ধসে পড়তে পারে সেজান জুসের পোড়া কারখানা ভবন
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের সেজান জুসের কারখানা ভবনটিতে আগুনের ভয়াবহতা এমন ছিল যে, ওই ভবনের সিমেন্ট ও রডের টেম্পারেচার নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে ছয়তলা ভবনটির পাঁচতলার মাঝের অংশ ধসে পড়েছে। আগুনের তাপ এতো বেশি ছিল যে, ছাদের আস্তরও খুলে খুলে পড়ছে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলা—এই তিনটি ফ্লোরের ছাদ আগুনের তাপে জায়গায় জায়গায় দেবেও গেছে। সব মিলিয়ে ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর।
তবে ঝুঁকি নিয়েই ভবনের ডাম্পিংয়ের কাজ করেছেন ফায়ার ফাইটাররা। পঞ্চম তলায় ফায়ার সার্ভিসের ডাম্পিংয়ের সময় ছাদের একাংশ ধসেও পড়ে।
গত ৮ জুলাই বিকেলে ওই কারখানা ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ঘটনার প্রথম দিন তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশত শ্রমিক। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর গত ৯ জুলাই সকালে ওই ভবনের চারতলা থেকে ২৬ নারীসহ ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সব মিলিয়ে এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২৯ ঘণ্টা পর ৯ জুলাই রাতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপ-পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) দেবাশীষ বর্ধন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ আগুন থাকার কারণে ভবনের টেম্পারেচার কমে গেছে। ঝুঁকি নিয়েই ফায়ার ফাইটাররা কাজ করেন। কাজ করতে গিয়ে গতকাল শনিবার (১১ জুলাই) পঞ্চম তলার ছাদ ধসে পড়ে। ভবনটিতে ছিল না ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন।
তিনি বলেন, ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার ছাদ ও ফ্লোর নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো সময় এই ছাদগুলো ধসে পড়তে পারে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ভবনের নিচতলায় ছিল গোডাউন। গেটের ওপরে লেখা সেন্ট্রাল স্টোর। সেখানে কার্টন, কর্ক, বোতল, প্লাস্টিক দানা মজুত রাখা হয়েছে। সেগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ৩-৪ প্রকারের জুস, ললিপপসহ বিভিন্ন ফুড আইটেমের কারখানা। চতুর্থ তলায় জুসের মেশিনের পাইপ ও প্যাকেজিং করার মেশিন রাখা। পঞ্চম তলায় জুস ও ললিপপ তৈরির ভারি মেশিন থাকতে দেখা যায়। এগুলো আগুনে পুড়ে ছাই-কয়লা হয়ে গেছে। ভবনের ষষ্ঠ তলা গোডাউন। সেখানে স্তরে স্তরে কার্টন রাখা হয়েছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার ছাদ আগুনে পুড়ে খসে পড়েছে। অনেক জায়গায় দেবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনের ছাদ (টপ ফ্লোর)। বিমগুলো থেকে ছাদ দেবে গেছে। জায়গা জায়গায় সিমেন্ট খসে পড়তেও দেখা গেছে।
ভবনে ছিল না ফায়ার সেফটি, নেয়া হয়নি ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটিতে কোনো প্রকার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।
অধিদফতরের ওয়্যার হাউজের কর্মকর্তারা বলেন, রূপগঞ্জে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত সেজান জুস তৈরির কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কোনো নকশা অধিদফতরের বিভাগে নেই। কারণ কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ফায়ার সেফটির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেই কারণে কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের কোনো ছাড়পত্র নেয়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘ভবনটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে ফায়ার ফাইটাররা সেখানে কাজ করেছেন। এছাড়া ভবনে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। ভবনের পরিধি অনুযায়ী সিঁড়ি রাখা হয়েছে মাত্র দুটি। তাও সরু। এছাড়াও ভবনের কোনো এক্সিট ওয়ে বা স্টেয়ার নেই। যে কারণে এতো প্রাণহানি ঘটেছে।’
নকশা অনুমোদনের আগেই নির্মিত হয়েছিল ভবনটি
গত শনিবার (১০ জুলাই) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভবনটি পর্যবেক্ষণ করে ইলেক্ট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামে একটি সংস্থা। তারা ভবনের বিভিন্ন অংশের পর্যবেক্ষণ করে।
সংস্থাটির সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম বলেন, ‘ভবনের নকশার অনুমোদনের আগেই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া এটি মূলত সেন্ট্রাল স্টোর হিসেবে করা হয়েছিল। ভবনের ফায়ার সেফটির কোনো অনুমোদন নেই। ভেতরে আমরা পরিদর্শন করে কোথাও সামান্য এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘এই ভবন নির্মাণে ও কারখানা পরিচালনায় অনেক ব্যত্যয় আমরা পেয়েছি। তবে নকশার অনুমোদনের আগে ভবন নির্মাণ করা একটি বড় ত্রুটি হিসেবে দেখছি আমরা। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা ঘটনাস্থলে কাজ করছি।’
বিন্দুমাত্র গাফিলতি থাকলে কারও ছাড় নেই : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানিকে ‘হত্যা’ মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বআসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘দোষীদের বিচার হবে। আগুনের ঘটনায় ইতোমধ্যে আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিন্দুমাত্র গাফিলতি থাকলে কারও ছাড় নেই।’
হত্যা মামলায় কারখানা মালিকসহ ৮ জন রিমান্ডে
অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানিতে পুলিশ বাদী হয়ে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা দায়ের করে। এ মামলায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল হাসেম এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহেনশাহ আজাদসহ আটজনকে আসামি করা হয়। বাকি আসামিরা হলেন—হাসেমের চার ছেলে (গ্রুপের ডিএমডি) হাসিব বিন হাসেম ওরফে সজীব, (পরিচালক) তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজীম ইব্রাহীম; হাসেম ফুডসের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মামুনুর রশিদ এবং সিভিল ইঞ্জনিয়ার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন
ওই মামলায় আসামিদের গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের আদালতে তোলা হলে বিচারক প্রত্যেককে চার দিনের রিমান্ডে পাঠান।
সূত্রঃ যুগান্তর।
আপনার মতামত জানান