তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তি

প্রকাশিত



কাউন্ট লিউ তলস্তয়ের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, বাংলা অনুবাদে যেটি ‘যুদ্ধ ও শান্তি’। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রুশ অভিযান। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও শান্তির জন্য মানুষের সংগ্রামই উপন্যাসটির মূল বক্তব্য। উনিশ শতকের রাশিয়ার জীবন ও মূল্যবোধকে তলস্তয় সুগভীর ও সুবিস্তৃতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন উপন্যাসটিতে এবং এতে বাস্তবধর্মী উপন্যাসের চূড়ান্ত শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে।

২০০৭ সালে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী সর্বকালের সেরা ১০টি উপন্যাসের তালিকায় তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ প্রথম ও ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ তৃতীয়। তার মানে সেরা দশের দুটিই তলস্তয়ের রচনা। টাইম ম্যাগাজিনের মতে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হচ্ছে ‘যুদ্ধ ও শান্তি’। তলস্তয়কে জীবিত সব লেখকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাবতেন দস্তয়ভস্কি। ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ পড়ে ফ্লবেয়ার মন্তব্য করেছিলেন, ‘কী মহান শিল্পী, কী অসামান্য মনস্তাত্ত্বিক!’ আন্তন চেখভের মূল্যায়ন ছিল, ‘যখন সাহিত্যের একজন তলস্তয় থাকে তখন লেখক হওয়া কতই না সহজ ও সুখের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’ পরবর্তীকালের বড় বড় লেখক তলস্তয়কে বিশ্বসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলে স্বীকৃতি দেন। তাঁদের মধ্যে প্রাউস্ত ও টমাস মান অন্যতম। ভার্জিনিয়া উলফ তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে। জেমস জয়েস বলেছেন, ‘তলস্তয় কখনোই নিরস, ক্লান্তিকর, জ্ঞানগর্ভমূলক বা নাটুকে নন।’

কিভাবে লেখা হয়েছিল ‘যুদ্ধ ও শান্তি’? উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ করেছেন কলকাতার খ্যাতিমান অনুবাদক অরুণ সোম। ‘কিছু কথা’ শিরোনামে চার খণ্ডের এই অনুবাদটির ভূমিকা সূত্রে আমরা জানতে পারি, উপন্যাসটির প্রায় পুরোটাই লেখা হয়েছিল তলস্তয়ের জমিদারিতে, যেটির অবস্থান মস্কো থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণে তুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানায়। রচনা শুরু হয়েছিল ১৮৬৩ সালে। তখন লেখকের বয়স প্রায় ৩৫ বছর। ইতিমধ্যে তিনি ‘কসাক’ উপন্যাস লিখে দেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি তখনই সুপ্রতিষ্ঠিত।

১৮২২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের পর রাশিয়ায় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অগ্রণী অভিজাত সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা ও ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। এই সময়ে দেশে বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন অভিজাতদের বেশ কয়েকটি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল। সেগুলোর সদস্যরা অনেকেই অবশ্য সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে প্রজাতন্ত্রীর সংখ্যাও কম ছিল না। ‘উদীচী সমিতি’ নামে পরিচিত এ রকম একটি সমিতির সদস্যরা ১৮২৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর পেতেরবুর্গের সেনাত স্কোয়ারে যখন জার নিকোলাইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, সেই সময়ে জারের সেনাবাহিনী কঠোর হাতে তাঁদের দমন করে। ডিসেম্বর মাসে এই ঐতিহাসিক সমাবেশ ঘটেছিল বলে পরবর্তীকালে এই আন্দোলনধারার অনুগামীরা ডিসেম্বরপন্থী বা ডিসেম্ব্রিস্ট বা দেকাব্রিস্ত নামে পরিচিত।

ডিসেম্বর অভ্যুত্থানের পাঁচ নেতার ফাঁসি হয়, ১২১ জনকে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৮৫৬ সালে জার প্রথম নিকোলাইয়ের মৃত্যুর পর যে অল্প কজন দণ্ডিত ডিসেম্ব্রিস্ট তখনো জীবিত ছিলেন, তাঁদের দণ্ডাদেশ মওকুফ করা হয়। সাইবেরিয়া থেকে তাঁদের প্রত্যাবর্তন স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন সৃষ্টি করে রুশ জনসমাজে। রুশ ইতিহাসের এই অধ্যায়টি তলস্তয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

১৮৫৬ সালে তলস্তয় ‘দেকাব্রিস্তি’ নামে একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তখন থেকে ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই এই বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করেছিলেন। কিন্তু ওই নামে কোনো উপন্যাস লেখা আর তাঁর হয়ে ওঠেনি। তাঁর সেই অসমাপ্ত রচনার ভিত্তিতে এরই মধ্যে তিনি ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ লিখে ফেললেন। এটির লেখা শেষ করেন ১৮৬৯ সালে। অর্থাৎ প্রায় সাত বছর লেগে গেল উপন্যাসটি লিখতে। ‘যুদ্ধ ও শান্তি’র শেষ দিকে উপন্যাসের অন্যতম নায়ক পিয়েরের ডিসেম্ব্রিস্টে পরিণত হওয়ার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে। ডিসেম্ব্রিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে শুধু এটুকুই যা সংযোগ শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসে থেকে গেল।

ডিসেম্ব্রিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে তলস্তয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১৮১২ সালের যুদ্ধের ঘটনাবলি, যা ছিল ওই আন্দোলনের প্রেরণাস্বরূপ। কিন্তু ওই সময়কার ঘটনাবলি অন্তর্ভুক্ত করার ফলে উপন্যাসের পরিসর ও কলেবর বাড়তে থাকে। শুরুতে যেখানে লেখকের পরিকল্পনা ছিল অভিজাত ও ভূস্বামী সম্প্রদায়ের রাশিয়ার চিত্ররূপায়ণ, সেখানে উপন্যাসটি রাশিয়ার ভূস্বামী ও কৃষক সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার সুবিস্তৃত চিত্ররূপ পরিগ্রহ করে, উনিশ শতকের প্রথম চতুর্থাংশের রুশ জনগণের মুক্তিসংগ্রামের দর্শনে পরিণত হয়। এ যেন লেখকের পরিকল্পিত উপন্যাসের আরম্ভেরও আরম্ভ।

প্রথম দুটি অংশ ‘রুশ বার্তা’ (রুস্স্কি ভ্যেস্ত্নিক) নামে মস্কোর একটি স্থানীয় পত্রিকার ১৮৬৫ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় এবং ১৮৬৬ সালের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যায় ‘১৮০৫ সাল’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর প্রকাশ স্থগিত রেখে তলস্তয় উপন্যাসটিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে থাকেন। অন্তত দুইবার বড় রকমের সংশোধন করেন। এ পর্যায়ে তিনি উপন্যাসের নাম দিয়েছিলেন ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’। কিন্তু উপন্যাসের পক্ষে এটি মোটেই আকর্ষণীয় কোনো নাম নয়। এই নামকরণ তিনি প্রাথমিকভাবে করেছিলেন কাহিনীর উপসংহারের দিকে লক্ষ রেখে এবং উপন্যাসের অন্যতম কৃষক চরিত্র কারাতায়েভের দর্শনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। কারাতায়েভ পিয়েরকে একটি গল্প বলেছিল, যার মূল কথা হলো ঈশ্বরের কাছ থেকে ভালোমন্দ সবই সমান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। কারণ ঈশ্বর যা করেন, তা ভালোর জন্যই করেন। উপন্যাসের এই পাঠে আন্দ্রেই বলকোনস্কি ও পেতিয়া রস্তোভ-দুজনেই শেষ পর্যন্ত জীবিত, কিন্তু চূড়ান্ত সংস্করণে তাঁরা যুদ্ধে নিহত হন।

পুনর্লিখনের ফলে উপন্যাসের পরিকল্পনার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু তত্ত্বকথাও সংযোজিত হয়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর প্রকৃতিতেও পরিবর্তন দেখা যায়। পূর্ববর্তী পাঠে ফিল্ড মার্শাল কুতুজভ ছিলেন নেতিবাচক। কিন্তু চূড়ান্ত ভাষ্যে কুতুজভ জ্ঞান ও সততার পরাকাষ্ঠা। সব কিছুরই একটা সময় আছে, কুতুজভ সেটা জানতেন, কিন্তু নেপোলিয়ন জানতেন না। এখানেই নেপোলিয়নের ওপরে কুতুজভের অবস্থান। এরই অনুষঙ্গে লেখক উপন্যাসে যোগ করেছেন তাঁর ইতিহাসের দর্শন। ইতিহাসের ঘটনাবলির কারণ যে নির্ধারণ করা যায় এবং তার গতিপথ সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়-এ ধারণা তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন।

১৮৬৭ সালের মার্চ মাসে তলস্তয় তাঁর নতুন উপন্যানের নাম স্থির করলেন ‘ভইনা ই মির’। অর্থাৎ ‘যুদ্ধ ও শান্তি’। ১৮৬৮ সালে এ নামেই উপন্যাসটির চূড়ান্ত সংস্করণ চার খণ্ডে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরের বছর আরো দুটি খণ্ড অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ড নিয়ে সমাপ্তি অংশসহ ‘যুদ্ধ ও শান্তি’র প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ওই বছরই একই আকারে অর্থাৎ ছয় খণ্ডে উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে সেখানে ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত প্রথম চারটি খণ্ডের পাঠ সংশোধিত হয়।

একটা কথা প্রচলিত আছে যে তলস্তয়ের স্ত্রী সোফিয়া আন্দ্রেইভনাকে সাতবার উপন্যাসটির বারবার সংশোধিত পাণ্ডুলিপি নকল করতে হয়েছে। কিন্তু ‘যুদ্ধ ও শান্তি’র পাণ্ডুলিপি ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখার পর তলস্তয়ের জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণের সম্পাদকরা ও অন্য গবেষকরা পরবর্তীকালে প্রমাণ করেছেন যে এটি অসম্ভব, অবিশ্বাস্য। ‘রুশ বার্তা’ পত্রিকায় যখন উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হয় তখন পরবর্তী খণ্ডগুলোর কাজই শুরু হয়নি। সোফিয়া আন্দ্রেইভনার পাণ্ডুলিপি নকলের কাজ ধীরে ধীরে লেখকের রচনার সমান্তরালে চলতে থাকে। উপন্যাসের কোনো কোনো জায়গায় তলস্তয় বারকয়েক পাল্টেছেন ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ অংশই তিনি সঙ্গে সঙ্গে লিখে প্রকাশ করেন কোনো অদল-বদল ছাড়াই। তা ছাড়া পাণ্ডুলিপি নকলের কাজে লেখক আরো কয়েকজনকে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন বেতনভুক। লেখক যা সংশোধন করার তার অনেকটাই অনেকবার প্রুফে করেছেন।

‘যুদ্ধ ও শান্তি’ বিশাল আকৃতির একটা উপন্যাস। ৫৫০টিরও বেশি চরিত্র নিয়ে উপন্যাসের যে সৌধ গড়ে উঠেছে, তার ভেতরভাগের নানা অলিন্দে এমন বেশ কিছু চরিত্র দেখা যায়, যারা সব সময় মুখ্য না হলেও উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসটির মাধ্যমে তলস্তয় যে আঙ্গিক তৈরি করেছেন, পরবর্তীকালে বড় বড় ঔপন্যাসিক তা অনুসরণ করেছেন। পৃথিবীর বহু ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।

লেখক : স্বকৃত নোমান
সুত্র : কালের কন্ঠ

আপনার মতামত জানান