জেনে নিন ফুসফুসে কী কী রোগ হয়
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) সিওপিডি বলতে বুঝি একটা মানুষ ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, ক্রনিক অ্যাজমা এই রোগগুলোতে আলাদাভাবে বা একসঙ্গে ভুগছে।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, এসফাইসিমা এবং ক্রনিক অ্যাজমা প্রতিটাই দীর্ঘস্থায়ী রোগ যার প্রকাশ হলো শ্বাসকষ্ট, বিশেষ করে হাঁটলে শ্বাসকষ্ট অনুভব করা। এ রোগগুলো আলাদাভাবে থাকতে পারে কিন্তু অনেকের এ রোগ ৩টির যে কোনো দুটি বা তিনটা একত্রেও থাকতে পারে।
সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে দেখা যায় যেসব মানুষ ধূমপান করত বা করছে অথবা কাঠের চুলার ধোঁয়ার মধ্যে নিয়মিত রান্না করছে তাদের মধ্যে সাধারণত ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস এবং এমফাইসিমা দেখা যায় কিন্তু এ রোগগুলো পরিবেশগত বা বংশগত কারণেও হতে পারে।
অ্যাজমা বা হাঁপানি অধূমপায়ীদেরও হতে পারে। এগুলো হওয়ার কারণ শুধু পরিবেশগত এলার্জি অথবা বংশগত কারণ নয়। এ ছাড়া আরও একাধিক কারণে অ্যাজমা বা হাঁপানি হতে পারে।
কিছু সংখ্যক লোকের এমফাইসিমা হয় জন্মগত। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এমফাইসিমা রোগীর রক্তে বায়ুথলি ধ্বংস রক্ষাকারী এনজাইম বা প্রোটিন আলফা-১ এনিট্রিপসিনের ঘাটতি থাকে যাকে বলা হয় আলফা-১ এন্টিট্রিপসিন ডেফিসিয়েন্সি বা শরীরে পর্যাপ্ত পরিমান ওই এনজাইম না থাকা।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস কী?
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস হলো শ্বাসনালির ভেতর কফ তৈরির গ্রন্থি বা গ্র্যান্ডগুলো অতিরিক্ত পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে নিয়মিত বেশি পরিমাণ শ্লেষ্মা বা কফ নির্গত হয়। আর এ অবস্থা সাধারণত ঘটে প্রতিনিয়ত শ্বাসনালিগুলো অতিরিক্ত পরিমাণ ধুলা, ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা এবং মাঝে মাঝে শ্বাসনালিতে ইনফেকশন হওয়ার কারণে।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস চিহ্নিত করা যায় অথবা নিশ্চিত হওয়া যায় যদি কাশির সঙ্গে নির্গত শ্লেষ্মা বা কফ প্রতিদিন হয় যা কমপক্ষে বছরে ৩ মাস বা তার অধিক সময় থাকে এবং এই কফ-কাশি যদি কমপক্ষে দুই বছর পর্যন্ত থাকে তবেই ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস বলা যায়।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস সৃষ্টি হলে শ্বাসনালিতে কফের পরিমাণ বেড়ে যায়। সেই রোগীর সকালে সাধারণত খুশখুশি কাশি হয়। কাশির সঙ্গে দৈনিক অল্প বা বেশি কফ নির্গত হয়। এ অবস্থার সঙ্গে বারবার শ্বাসনালিতে ইনফেকশন হয়। অতিরিক্ত কফ বা শ্লেষ্মার কারণে ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
ধীরে ধীরে ছোট ছোট শ্বাসনালিগুলো ইনফেকশন এবং শ্লেষ্মার কারণে বন্ধ হতে থাকে। যার কারণে বাতাস শ্বাসনালি দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করা এবং ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্বাসনালিগুলো সংকুচিত হয় এবং কফ বা শ্লেষ্মা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে কাশি, কফ এবং হাঁটলে শ্বাসকষ্ট এ উপসর্গগুলো একসঙ্গে বা আলাদা আলাদাভাবে দেখা দেয়। অতিরিক্ত শ্লেষ্মা বা কফ তৈরির কারণে ঘনঘন ইনফেকশন হয়।
এ শ্বাসনালিগুলো সরু হওয়ার কারণে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করা এবং বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যে কারণে শ্বাসকষ্ট হয়।
এমফাইসিমা কী?
এমফাইসিমা হলো এমন একটা অবস্থা যেখানে শরীরের বায়ুথলিগুলো (এলভিউলাই) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায় এবং বায়ুথলির মাঝের দেওয়ালগুলো ভেঙে বড় বড় বায়ুথলি তৈরি হয়। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র শ্বাসনালিগুলো সরু হয়ে যায় এবং ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকতা হারায় অর্থাৎ বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করলে বেলুনের মতো ফুসফুস ফুলে উঠতে পারে না।
একই কারণে শ্বাস ফেলার সময় বাতাস সহজে ফুসফুস থেকে বের হয় না। এমফাইসিমাতেস্বাভাবিকের অবস্থায় ফোলা বেলুনের মতো ফুসফুস বড় থাকে। এ অবস্থাকে ‘বাতাস আটকে যাওয়া ফুসফুস’ বা ‘হাইপার-ইনফ্লেটেড ফুসফুস’ বলে।
আটকে যাওয়া বাতাসের কারণে ফুসফুসের আয়তন বড় হয়ে যায়। যেটাকে ব্যারেল চেষ্ট বা ড্রামের মতো বুক বলে এবং ফুসফুসের এ প্রতিনিয়ত এ ড্রামের মতো বেড়ে যাওয়া ফুসফুসে বাতাস ঢুকাতে ও বের করতে অতিরিক্ত পরিশ্রম হয় বিধায় রোগী বসে থাকলে শ্বাসকষ্ট কম অনুভব করে কিন্তু হাঁটলে বা তাড়াহুড়া করলে শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। এটাই সিওপিডির গোড়ার দিকের প্রধান পরিবর্তন।
আলফা-১ এন্টিট্রিপসিন ডেফিসিয়েন্সি (অভাব) কী?
এটা হলো একটি বংশগত সমস্যা। যেসব মানুষের রক্তে আলফা-১ এন্টিট্রিপসিন এনজাইমের ঘাটতি আছে তাদেরই সিওপিডি হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আলফা-১ এন্টিট্রাপসিন একটা বিশেষ উপাদান যা রক্তে সব সময় বিদ্যমান থাকে। এটার কাজ হলো ফুসফুসকে ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করা।
মানুষের ধারাবাহিক জীবনে ফুসফুসের বায়ুথলির জন্য ক্ষতিকর সূক্ষ্ণ পদার্থগুলো প্রতিনিয়তই নিশ্বাসের উপকরণ হিসাবে যেমন : দূষণকারী বন্তু, জীবাণু, ধুলা-বালি এবং সিগারেটর ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসে। আলফা-১ এন্টিট্রিপসিন (AA1) ফুসফুসের বায়ুথলিকে এসব দূষণকারী জিনিস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৪০ বছরের নিচে কোনো মানুষের সিওপিডি রোগ দেখা দিলে আমরা আলফা-১ এন্টিট্রিপসিন অভাবজনিত কারণ একটি প্রধান কারণ মনে করে থাকি।
অন্যান্য শ্বাসকষ্ট রোগ
সিওপিডির মতো শ্বাসকষ্টজনিত ফুসফুসের আরও কিছু রোগ আছে। চিকিৎসার জন্য প্রতিটা রোগকে আলাদা আলাদাভাবে চিনতে হবে। প্রকাশ শ্বাসকষ্ট হলেও প্রতিটা রোগ আলাদা এবং চিকিৎসাও আলাদা।
এ রোগগুলোর মধ্যে অ্যাজমা বা হাপানি, ইন্টারস্টিসিয়াল লাং ডিজিজ, ব্রঙ্কিএকটেসিস এই ৩টি রোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারনে এই ৩ রোগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেয়া হলো-
অ্যাজমা বা হাঁপানি কী?
অ্যাজমা একটি দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসনালির রোগ যেখানে বিভিন্ন উত্তেজকের প্রভাবে শ্বাসনালিগুলো সংকুচিত হয় এবং শ্বাসনালির ভেতরটা লাল হয়ে ফুলে যায়। এর মূল উত্তেজক বা কারণ হিসাবে ঠান্ডা বাতাস, ফুলের রেণু, ঘরের ধূলায় অবস্থিত মাইট নামক কিট ইত্যাদিকে ধরা হয়।
শ্বাসনালির ভেতরটা ফুলে যাওয়া এবং শ্বাসনালির পেশিগুলো সংকুচিত হওয়ার কারণে নিশ্বাস ফেলার সময় সাঁই সাঁই শব্দ করা, বুকের ভেতর আটসাট অনুভব করা, শ্বাস নিতে-ফেলতে কষ্ট/অথবা শুকনা কাশি নিয়ে হাঁপানি রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।
হাঁপানিতে আক্রান্ত রোগীর সংকুচিত শ্বাসনালির মধ্যে বাতাস চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় যেমনটা হয় সিওপিডির ক্ষেত্রেও। তাই অনেক সময় হাঁপানি থেকে সিওপিডি আলাদা করা কঠিন হয়। কিছু মানুষের সিওপিডি এবং অ্যাজমা দুটিই থাকতে পারে।
অ্যাজমাকে সবাই রোগ হিসাবেই জানে যেটা কিনা বাচ্চা এবং প্রাপ্ত বয়স্ক যে কারও হতে পারে। অ্যাজমা বা হাঁপানিতে আক্রান্তের সময় শ্বাসনালিগুলোতে প্রদাহ হয় এবং ভেতরটা ফুলে যায়, শ্বাসনালি সংকুচিত হয় এবং শ্লেষ্মা/আঠালোজাতীয় কফ তৈরির কারণে বাতাস চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। এ শ্বাস নেওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বলে নিশ্বাস নিতে এবং ফেলতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়।
সিওপিডি এবং অ্যাজমা : সিওপিডি এবং অ্যাজমা-হাঁপানির লক্ষণগুলো-উপসর্গগুলো প্রায় একই রকম হওয়ায় দুটির মধ্যে পার্থক্য করা অনেক সময় মুশকিল হয়ে পড়ে।
আমরা এটা জানি যে অনেক লোকের সিওপিডি এর সঙ্গে সঙ্গে ক্রনিক হাঁপানি ও থাকে বিশেষ করে যাদের বয়স ৫০ বছর এর ঊর্ধ্বে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অনেক সিওপিডি রোগীকে হাঁপানির রোগী হিসাবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
হাঁপানি এবং সিওপিডি দুটি আলাদা অসুখ এবং সৃষ্টির কারণ ভিন্ন। এ রোগ দুটি শরীরে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে এবং এদের চিকিৎসাও তাই কিছুটা ভিন্ন। এ কারণে হাঁপানি, সিওপিডি এ দুটিই সঠিকভাবে নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ। লাং ফাংশন টেস্টের (স্পাইরোমেট্রি) মাধ্যমে বেশিরভাগ সময় সঠিকভাবে এ দুই রোগকে পার্থক্য করা যায়।
ব্রঙ্কিএকট্যাসিস কী?
ব্রঙ্কিএকট্যাসিস হলো ফুসফুসের এমন একটি অসুখ যেখানে শ্বাসনালিগুলোর ভেতরের মাংসের আস্তরণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শ্বাসনালিগুলো সব সময় প্রসারিত অবস্থায় থাকে। ফলে শ্বাসনালি ভেতর কতগুলো পকেটের মতো গর্ত সৃষ্টি হয়। এ পকেটগুলোতে প্রচুর পরিমাণ কফ জমা হয় এবং এ জমে থাকা কফে ইনফেকশন হয়। এ ইনফেকশন সাধারণত ভালো হতে চায় না।
মাঝে মাঝে এ ইনফেকশন থেকে দ্রুত ফুসফুসে ইনফেকশন ছড়িয়ে নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে। আবার মাঝে মাঝে ইনফেকশনের কারণে শ্বাসনালীর গর্তগুলো থেকে রক্তপাত হয় এবং কাশির সঙ্গে টাটকা রক্ত আসতে থাকে। ব্রঙ্কিএকট্যাসিস সাধারণত ধূমপান বা ধোয়া থেকে হয় না এবং এটি সাধারণত ফুসফুসে যক্ষ্মা বা অন্য কোনো গুরুতর ইনফেকশন হওয়ার কারণে হয়ে থাকে।
বারবার শ্বাসনালির ইনফেকশনের সঙ্গে সঙ্গে কফের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (দৈনিক ১/২ কাপের বেশি কফ নির্গত হওয়া) এ রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেটা পরবর্তিতে কোনো এক সময় দীর্ঘমেয়াদি ইনফেকশন এবং দীর্ঘমেয়াদি কাশিতে পরিবর্তন হয়।
সাধারণত কফ দেখতে সাদা। যদি এই রং পরিবর্তিত হয়ে যেমন হলুদ, বাদামি, কিংবা সবুজ হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে এটা ইনফেকশন। কখনো কখনো ব্রঙ্কিএকট্যাসিস আছে এমন লোকদের কফ বর্ণহীনও হতে পারে যখন তারা ভালো থাকে।
ব্রঙ্কিএকট্যাসিস-এর মূল চিকিৎসা হল-
১) ফুসফুস থেকে কফ পরিষ্কার করার পদ্ধতি শেখা কফ কমানো এবং বুক থেকে কফ পরিষ্কার করার জন্য দৈনিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
২) বারবার ইনফেকশন প্রতিরোধ করা- এটা হলো বিভিন্ন সংক্রমণ রোগের টিকা নেওয়ার মাধ্যমে, ব্যথামুক্তকরণ, শ্বাসের ওষুধ ব্যবহার এবং কখনো কখনো এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ।
৩) ফুসফুস পুনর্বাসন কার্যক্রম- ফুসফুসের শক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নিয়মিত ফুসফুসের ব্যয়াম করতে থাকা।
সূত্রঃ যুগান্তর।
আপনার মতামত জানান