চমক নাকি নতুন ইতিহাস
মাঝে আর একটি দিন। কাল এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ভোট দেবেন আমেরিকান জনগণ। চার বছর আগে এমনই এক ভোটে জয়ী হয়ে পুরো বিশ্বকে চমকে দেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে চমক ধরে রাখার প্রত্যাশায় ট্রাম্প দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে রীতিমতো ঘূর্ণি প্রচার চালাচ্ছেন। করোনায় ভোগা এই প্রেসিডেন্ট ২০১৬ সালের প্রচার ভোলেননি, সে আদলও ছাড়েননি। এবারও সেই একই চিত্রনাট্য—বিপুল জনতা, গণমাধ্যমকে গালি, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আর সকৌতুকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা। নিজে করোনায় ভোগার পরও গণমাধ্যমের চোখে ‘লোক-দেখানো সার্কাস’ নামে অভিহিত জনসভার পরীক্ষিত এই কাঠামো থেকে বের হননি ট্রাম্প।
আর প্রচলিত এই কাঠামোর মধ্যে একটিবারের জন্যও প্রবেশ করেননি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। ছোট ছোট সমাবেশ, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, রস নয় পরীক্ষিত তথ্য আর পরিসংখ্যান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ চালানো, সর্বপরি দলের পূর্ববর্তী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নেতিবাচক ভাবমূর্তির আবহ থেকে বের হয়ে আসা—এভাবেই এবং শুধু করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করে নির্বাচনী প্রচারের এই কঠিন তরিকে প্রায় তীরে ভিড়িয়ে ফেলেছেন বাইডেন। অন্তত শেষ মুহূর্তের জরিপগুলো সে আভাসই দিচ্ছে। রয়টার্স বা ইপসোস বলছে, জাতীয়ভাবে দুই অঙ্কের সংখ্যায় এগিয়ে আছেন তিনি। আর দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর একটিতেও প্রেসিডেন্ট তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। যদিও ব্যবধান খুব বেশি নয়।
এর সঙ্গে আরেকটি খবর বাইডেনের জন্য সুখবর হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে—আগাম ভোটের সংখ্যা ৯ কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর একটি বড় অংশই ডেমোক্রেটিক পার্টির নিবন্ধিত ভোটার। সংখ্যার হিসাবে ২০১৬ সালের নির্বাচনের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট এরই মধ্যে ব্যালট বাক্সে ঢুকে গেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এবার স্মরণকালের সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পড়বে।
নির্বাচনের মাত্র দুই দিন হাতে রেখে গত শনিবার দুই প্রার্থী প্রচারে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ৭৪ বছর বয়সী ট্রাম্প ৭৭ বছর বয়সী বাইডেনকে ছাড়িয়ে গেছেন। এয়ারফোর্স ওয়ানে সওয়ার হয়ে শনিবার পেনসিলভানিয়া রাজ্য চষে বেড়ান তিনি। চারটি জনসভা করেছেন। এগুলো ট্রাম্পীয় জনসভার মতো হাজারো লোকের সমাবেশ না হলেও বাইডেনের মতো গুটিকয়েক লোকের জড়ো হওয়ার মতো বিষয়ও ছিল না। ট্রাম্প মূলত এই জনসভাগুলোকেই তাঁর জনমত জরিপ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি মনে করেন, তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয় এই জনসভাগুলোই। আর এই জনসভাগুলোতে সমর্থকদের তুষ্ট করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি তিনি। করোনাভাইরাস নিয়ে গোড়া থেকেই উপহাস করেছেন ট্রাম্প। এবার সেই উপহাসে শামিল করেছেন নিজের পরিবারকেও। ফার্স্টলেডি মেলানিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব রয়েছে বলে বাজারে যে গুজব চাউর আছে সেদিকে ইঙ্গিত করে এদিন তিনি বলেন, ‘এবার অন্তত মানুষ বুঝবে আমরা এক ঘরেই বাস করি।’
তবে শুধু কৌতুকই নয়, সত্য-মিথ্যা নানা তথ্য দিয়েই ভাষণকে রঙিন করার চেষ্টা করেন পুনর্নির্বাচনপ্রত্যাশী প্রেসিডেন্ট। যেমন—শনিবার চারটি জনসভাতেই তিনি দাবি করেন, ‘করোনাভাইরাস ধাপ্পাবাজি। মহামারি বলতে কিছু নেই। চিকিৎসক ও নার্সরা বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছেন।’ ট্রাম্পের এ বক্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রে গত আট মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুই লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। এক কোটি মানুষের আক্রান্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আগাগোড়া অদক্ষতা আর ঔদাসীন্যে যেভাবে এই মহামারি ‘মোকাবেলা করা’ হয়েছে, তাতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হলে, সবাই মাস্ক পরলে, গোড়া থেকেই র্যাপিড টেস্টের বন্দোবস্ত হলে এবং সর্বোপরি সুযোগ্য নেতৃত্ব থাকলে এই মৃত্যুর অন্তত ৯০ শতাংশ এড়ানো যেত!
বাড়তে থাকা বেকারত্ব, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিষেবা—এই সাত মাসে সমাজের দরিদ্র অংশটাকে যেন আরো জীর্ণ করে ফেলেছে। ট্রাম্পের প্রধান দাবিই হচ্ছে তাঁর আমলেই সেরা অর্থনীতির মুখ দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র! কিন্তু তথ্য বলছে, করোনার আগে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ওবামা আমলের মতোই ছিল। ট্রাম্প এ-ও দাবি করেন, করোনার আগে তাঁর আমলেই দেশের বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন ছিল। কিন্তু ওবামা আমল থেকেই যে এই হার কমছিল, সেটা ভুলেও উল্লেখ করেন না তিনি। তাঁর আমলে কৃষ্ণাঙ্গদের উন্নয়ন নিয়ে ট্রাম্পের দাবির ভিত্তি হলো, এদের কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু সেটাও বেশ কয়েক দশক ধরে একই রকম হারে বাড়ছিল। করোনায় আবার এরাই অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে গেছে।
এদিকে গত শুক্রবার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ট্রাম্পের নির্বাচনী জনসভার কারণে ৩০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে সাত শরও বেশি মানুষের। ট্রাম্প অবশ্য এসব সমীক্ষাকে খুব একটা পাত্তা দেন না। কারণ প্রচারের কোনো পর্যায়েই খুব একটা মাস্ক পরেননি তিনি। তাঁর সমর্থকদেরও একই অবস্থা।
সমীক্ষার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর বাইডেন সেটাকে হাতিয়ার করে জোর প্রচার শুরু করেন। ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে দেশবাসীর উদ্দেশে বাইডেন বলেন, ‘আপনাদের প্রতি যত্নশীল নন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নিজের সমর্থকদের কথাও চিন্তা করেন না তিনি।’ ডেমোক্রেটিক পার্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা বারাক ওবামাকে পাশে নিয়ে মিশিগানের প্রচার চালানোর সময় বাইডেন বলেন, ‘ট্রাম্পের ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরার সময় হয়েছে। মিথ্যা ফুলঝুরি উড়াচ্ছেন তিনি। গত চার বছরে আমরা বহু নৈরাজ্য দেখেছি, টুইটে আত্মগর্ব পড়েছি, রাগ, ক্ষোভ, ব্যর্থতা, দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করতে দেখেছি। এসব আর দেখতে চাই না।’
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্টের পক্ষে ভোট চেয়ে বলেন, ‘এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গলাবাজি করার জায়গা নয়, গালি দেওয়ার জায়গাও নয়। এটা টিভির রিয়েলিটি শো বা খেলার প্রতিযোগিতা নয়। এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন। আর বাইডেন আপনাদের ছেড়ে যাবে না। সহমর্মী হয়ে আপনাদের সঙ্গে থাকবে। বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করুন।’ সপ্তাহখানেক ধরেই বাইডেনের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন ওবামা। আজ এবং আগামীকাল সোমবারও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাবেন তিনি।
এবার অবশ্য ভাগ্যও বাইডেনের পক্ষে বলেই মনে হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকেই এগিয়ে সব ধরনের জরিপে এগিয়ে তিনি। সর্ব শেষ প্রকাশিত রয়টার্স অথবা ইপসোসের জরিপে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে বাইডেন (৫১%) ট্রাম্পের (৪৩%) চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। গত ২৭-২৯ অক্টোবর এ জরিপ চালানো হয়। দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতেও এগিয়ে বাইডেন। তবে ব্যবধান কম। লড়াই মূলত হবে এই রাজ্যগুলোতেই। এগুলোর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই নির্বাচিত হবেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক কারণ বাইডেন জিতলে তিনিই হবেন দেশের প্রবীণতম প্রেসিডেন্ট। তাঁর সঙ্গী কমলা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হলে, সেটাও হবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে তিনিই হবেন দেশের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত সে বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না।
আর যদি ট্রাম্পই জিতে যান! তা হলে তিনি হবেন অভিশংসনের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেকখানি পিছিয়ে থেকেও পুনর্নির্বাচিত হলেন। পপুলার ভোটে গতবার হিলারির চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। এবারও নিশ্চিতভাবেই বলে দেওয়া যায় অন্তত এ ক্ষেত্রে বাইডেনকে ছাড়াতে পারবেন না তিনি। তাঁর যত মারপ্যাঁচ সবই ইলেকটোরাল ভোটকে কেন্দ্র করে। সূত্র : সিএনএন, বিবিসি, এএফপি, দি ইনডিপেনডেন্ট।
আপনার মতামত জানান