খাজা টাওয়ারে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজধানীর মহাখালীর খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ঝড়ে গেছে তিনটি প্রাণ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনে একটি জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি থাকলেও সেটি ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। তাই আটকা পড়া মানুষেরা বের হতে পারেননি। তবে স্বজনেরা উদ্ধার কার্যক্রম বিলম্ব হওয়াকে দুষছেন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৮ মিনিটের দিকে অগ্নিকাণ্ডের খবর পাই, ৫ টা ৭ মিনিটে আমাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে যায়। ভবন থেকে ১০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ভবনে অগ্নিনির্বাপণ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। একটি জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি থাকলেও সেটি ব্যবহার উপযোগী ছিল না। তাই আটকা পড়া মানুষেরা বের হতে পারেননি।’
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ভবনটির নিরাপত্তা দেখভাল করছি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভবনটি ব্যবহার উপযোগী কিনা তা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দেখবে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসও আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে তা তদন্ত করবে। এই ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। এছাড়াও দুর্ঘটনা জনিত একটি মামলা হবে।’
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর আজ শুক্রবার ভবনটি থেকে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। অস্থায়ী ভিত্তিতে অন্য ভবনে তারা কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করছে। যাতে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা দিতে পারেন।
সরেজমিনে ভবনের ভেতরে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডে ভবনটির বৈদ্যুতিক সংযোগ পুড়ে গেছে। ভেতরে বিভিন্ন অফিসের ইন্টেরিয়র পুড়ে ছাই হয়েছে। তাই সহসা এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে না। সবকিছু কবে নাগাদ ঠিক হবে তা এখনো নিশ্চিত না।
ভবনটির নিরাপত্তা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আগে কী কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা দেখা হচ্ছে। এরপর সিদ্ধান্ত হবে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করার। তারপর ভবন ব্যবহারের জন্য কীভাবে উপযোগী করা হয়, তা দেখা হবে।
ভবনটি একটি পূর্ণাঙ্গ টেলিকম হাব। এখানে অসংখ্য ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও বেশ কয়েকটি মুঠোফোন কোম্পানির ডাটা সেন্টার। দেশের ৭০ শতাংশ প্রযুক্তি সার্ভার ভবনটিতে। আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় ভবনটি বনানী থানা-পুলিশকে বুঝিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস। থানা-পুলিশ ভবনটি বুঝে নিয়ে পাহারা বসিয়েছে।
১৫ তলা ভবনের চার তলা থেকে ওপরের দিকে প্রতিটি তলায় আগুন ছড়িয়েছে। ভেতরে ধোয়ার তীব্র গন্ধ। এখনো দুই-তিন মিনিট থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। ১১, ১২ ও ১৩ তলায় আগুন ছড়িয়েছে বেশি। ভবনের ২, ৩, ৫, ৭, ১২, ১৩ ও ১৪ তলায় সাইফ পাওয়ার টেক নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস।
বাকিগুলো হলো—ভবনের নিচতলায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, চতুর্থ তলায় গ্রামীণ ফোনের সার্ভার, অষ্টম তলায় সেবা গ্রুপ, নবম তলায় আর্থ টেলিকমিউনিকেশন, ১০ তলায় ঢাকা কোলো প্রাইভেট লিমিটেড।
এছাড়া ১১ তলায় এনআরবি টেলিকম নামে একটি ডাটা সেন্টারের অফিস রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের অফিস থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বের করে অন্য ভবনে সেগুলো সরিয়ে নিতে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটির টেকনিশিয়ান মোফিজুর রহমান বলেন, ‘মহাখালীর একটি ভবনে নতুন করে সার্ভার চালু করে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এখান থেকে সার্ভার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
ভবনটির ১৫ তলায় খাজা টাওয়ারের অফিস এবং একাংশে সাইফ পাওয়ার টেকের সাইফ প্লাস্টিক অ্যান্ড পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি অফিস রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনটিতে ছিলেন সাইফ পাওয়ার টেক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তরফদার মোহম্মাদ রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পরপরই আমাদের কর্মীরা এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করেছিল তাই আগুন বেশি স্প্রেড করতে পারেনি। আমরা ধারণা করছি, আমাদের তৎপরতার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হতে পারে। তবে এই ক্ষতি রিকভার করে কবে নাগাদ আমাদের অফিস চালু করতে পারব তা এখনো কিছু বুঝতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট পুরোটাই পুড়ে গেছে। অন্যান্য অফিসগুলো অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের হিউজ পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে তবে আমাদের নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকলে এই ক্ষতি আরও বেশি হতে পারত।’
তিনি আরও বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে মোট তিনজনের মধ্যে আমাদের অফিসের একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মারা গেছেন। তার নাম রফিকুল ইসলাম। এছাড়া আমাদের অনেক কর্মী এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন।’
রফিকুল ইসলাম ছাড়াও এই ঘটনায় নিহত অপর দুই নারী হলেন হাসনে হেনা ও আকলিমা রহমান। নিহত আকলিমার ভাই রিয়াসাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যখন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তখন আমার বোনকে অনেকের সঙ্গেই আটকা পড়া অবস্থায় ভিডিওতে দেখেছি। সে আমার এক ফুপাতো বোনের স্বামীকে ফোন দিয়ে সহযোগিতাও চেয়েছিল। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। তাকে রাত ১২টার সময় মৃত উদ্ধার করে।’
তদন্ত কমিটি গঠন
খাজা টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটিতে আছেন—লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, এসজিপি, পিএসসি, পরিচালক (অপাঃ ও মেইনঃ), মো. ছালেহ উদ্দিন, উপপরিচালক, ঢাকা বিভাগ, মো. আনোয়ারুল হক, সহকারী পরিচালক, ঢাকা, মো. তানহারুল ইসলাম, উপসহকারী পরিচালক, ঢাকা, জোন-২ এবং মো. নাজিম উদ্দিন সরকার, সিনিয়র স্টেশন অফিসার, তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন।
অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের মাধ্যমে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত জানান