এমএ পাস চা-ওয়ালা

প্রকাশিত



মাস্টার্স পাস একজন যুবক চায়ের দোকান দেবেন এটা অনেকে মেনে নিতেই পারছিল না। তা-ও আবার দোকানের নাম হবে ‘এমএ পাস চাওয়ালা’!

কিন্তু লোকের কথায় পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ নন মোহা. শহিদুল ইসলাম। পরিশ্রম করে সৎ উপার্জনের চেয়ে আর কিছুই বড় নয়—এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী যুবকটি তাঁর আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করে ছেড়েছেন।

পরিবারের অন্যরা শহীদুলকে বলেছিল, চায়ের দোকান না দিয়ে অন্তত ক্যাফে জাতীয় কোনো কিছু করতে, যাতে তথাকথিত ‘সমাজের চোখে’ বিষয়টা একটু সম্মানজনক হয়।

কিন্তু সবার কথা উপেক্ষা করে তিনি চায়ের দোকানই দিয়েছেন। নামও দিয়েছেন ‘এমএ পাস চাওয়ালা’।

‘ছয় মাস ধরে অনেক ভেবেচিন্তে দোকানের এই নাম দিয়েছি। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। কষ্ট আছে। প্রধান দুটি কারণের একটি হচ্ছে, নাম দিয়ে আকর্ষণ করে ক্রেতার নজরে আসা। দ্বিতীয়ত, এই নামের কারণে যাতে অন্য শিক্ষিত বেকার যুবকরা অনুপ্রাণিত হন। কেউ যাতে চায়ের দোকানের মতো ব্যবসাকে ছোট করে না দেখেন,’ বলেন রাজধানীর ভাটারা এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম (৩৪)।

অক্টোবরের শুরুতে রাজধানীর ভাটারায় কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে ‘এমএ পাস চাওয়ালা’ দোকানের যাত্রা শুরু। এই স্বল্প সময়েই এলাকার চাপ্রেমীসহ স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সাড়া ফেলেছে উদ্যোগটি। এর মধ্যেই চা খেতে আসা কয়েকজন শহীদুলকে বলেছেন, সব সংকোচ ভেঙে তাঁরাও আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ীই কিছু একটা করবেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তরুণ শহীদুল রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে দুই-তিন বছর চাকরির জন্য চেষ্টা করেও পছন্দমতো কাজ পাননি। পরে ফ্রিজের দোকান দেন। তবে সেখানেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর উদ্যোগ নেন একটি অনলাইন স্কুলের। স্কুলটি নিয়ে এগোনোর মধ্যেই এক পর্যায়ে ঠিক করেন ‘এমএ পাস চাওয়ালা’ নামে চায়ের দোকান দিয়েই এবার ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করবেন।

চায়ের দোকান দেবেন এ জন্য ঘর ভাড়া নিতে বেগ পেতে হয়েছে বলে জানান শহীদুল। বললেন, ‘যখনই কোনো দোকান ভাড়া নিতে যাই, তখন চায়ের দোকান হবে শুনে মালিক দিতে রাজি হন না। অনেককে মোবাইলে কল দিলেও এটা শুনেই কেটে দেয়। ’

জেদ চেপে যায় শহীদুলের। ঠিক করেন সমাজে যারা এ ধরনের কাজকে ছোট করে দেখে, তাদের ভুল ভাঙানোর জন্য চায়ের দোকানই দেবেন। আর নাম দেবেন ‘এমএ পাস চাওয়ালা’।

শহীদুলের বাধা জয়ের যাত্রায় তাঁর স্ত্রী শ্যামলী আক্তারের অনুপ্রেরণা ছিল উল্লেখযোগ্য।

পরিপাটি করে সাজানো শহীদুলের দোকানের ভেতর-বাহির। সেখানে থরে থরে সাজানো তামার তৈরি আরবি কেতার কেটলি। চা তৈরির নানা সরঞ্জাম রাখা বিভিন্ন পাত্রে। স্কুল-কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্রেতারও দেখা মিলল।

শহীদুল জানান তাঁর বেশির ভাগ খদ্দের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। হরেক রকমের চায়ের পাশাপাশি মাংসের স্পেশাল শিঙাড়া খেতে আসেন অনেকে। বর্তমানে তাঁর দোকানে রয়েছে ইরানি জাফরান চা, টার্কিশ লাল চা, ইরানি দুধ চা, আমেরিকান চকোলেট দুধ চা, ইন্ডিয়ান মালাই চা, স্পেশাল মাসালা চা, স্পেশাল লাভ চাসহ বিচিত্র নামের ও স্বাদের চা।

পাশের এক মুদি দোকানের কর্মী মানিক বলেন, ‘এমএ পাস চাওয়ালা নামটা চোখে পড়ার মতো। আমার মনে হয়, এ নামের কারণে অনেক শিক্ষিত বেকার উৎসাহ পাবে। বসে না থেকে এ ধরনের কাজে নিজেদের যুক্ত করবে। ’

মানিকের মন্তব্য, অনেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ছোটখাটো কাজ করলেও প্রকাশ্যে আসেন না বা সহজে স্বীকার করতে চান না। কিন্তু শহীদুল এটা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাই তিনি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারেন।

আপনার মতামত জানান