ইয়াবা-গ্রেফতার বাণিজ্য জেনে যাওয়ায় সিনহা হত্যা

প্রকাশিত

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান পরিকল্পিতভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ এবং পরিদর্শক লিয়াকতের ইয়াবা ও গ্রেফতার বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম জেনে যাওয়ায় তারা বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। যে কারণে টেকনাফ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয় সিনহাকে। হুমকি সত্ত্বেও না যাওয়ায় পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়। এমনকি থানায় বসে সোর্সদের নিয়োগ করা হয় হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। মৃত্যু নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও সরাসরি জড়িত ছিলেন ওসি প্রদীপ।

রোববার (১৩ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কারওয়ান বাজারস্থ র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এসব তথ্য জানান।

তিনি জানান, ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ থানাধীন মেরিন ড্রাইভে বাহারছড়া ক্যাম্পের কাছে মেজর সিনহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় সব মিলিয়ে মোট ৪টি মামলা দায়ের করা হয়। আদালতের নির্দেশনায় মামলাগুলোর তদন্ত করে র‍্যাব। মামলাগুলো হলো- মাদক সংক্রান্ত, পুলিশের কাজে বাধা, রামু থানায় শহিদুল ইসলাম সিফাত ও মেজর সিনহাকে আসামি করে মামলা দায়ের এবং মেজর সিনহার বোনের দায়ের করা হত্যা মামলা।

আশিক বিল্লাহ জানান, আদালতের নির্দেশে র‌্যাবের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার এ বি এম খায়রুল ইসলামকে তদন্তে নিযুক্ত করা হয়। তিনি প্রভাবহীনভাবে তদন্ত কাজ পরিচালনা করেন। মোট ৪ মাস ১০ দিনের মাথায় তদন্ত কর্মকর্তা আজ এ হত্যা মামলার ২৬ পৃষ্ঠার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেন। এ মামলায় মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট গঠন করা হয়। এদের মধ্যে নয়জন টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্য, তিনজন এপিবিএন সদস্য (বরখাস্ত) ও তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। তারা সবাই গ্রেফতারের পর কারাগারে রয়েছেন। তবে মামলার আরেক আসামি কনস্টেবল সাগর দে এখনো পলাতক। এদিকে আরও দুজনকে অভিযুক্ত করে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল নাম-ঠিকানা ভুল থাকায় তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

চাঞ্চল্যকর এ মামলায় র‌্যাব পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে উল্লেখ করে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, তদন্তকালে মোট ৮৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে র‍্যাব। গ্রেফতার ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা এখনও দায় স্বীকার করেননি বলেও জানান এ কর্মকর্তা।

তিনি আরও জানান, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে আদালতের নজরে এনেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নিজেই। তিনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ধামাচাপার চেষ্টা এবং ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলালের সহযোগিতা ও এপিবিএনের তিন সদস্যের সহায়তায় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। ওসি প্রদীপের ষড়যন্ত্রে আরও পাঁচজন সরাসরি অংশ নেন। তারা হলেন- পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, আইয়াজ ওরফে আয়াজ, নিজামউদ্দিন। পরবর্তী সময়ে ফাঁড়ির এসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন আজাদ, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন হত্যা নিশ্চিতে ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও ওসি প্রদীপকে সহায়তা করেন। শুধু তাই নয়, ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সিনহার গাড়িতে মাদক উদ্ধারের নাটক সাজান রুবেল শর্মাসহ পলাতক সাগর দে।

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, গত ৭ জুলাই শিপ্রা দেবনাথ, শহিদুল ইসলাম সিফাত ও আরেক সহকর্মীসহ মেজর সিনহা একটি ইউটিউব চ্যানেলের কাজে যান। কক্সবাজার এলাকায় ভিডিও ধারণ করছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে স্থানীয়দের সখ্যতা গড়ে ওঠে। সে সময় ওসি প্রদীপের নির্যাতনের ঘটনা এবং ইয়াবা বাণিজ্য সম্পর্কে তারা তথ্য পায়। এ বিষয়ে ওসি প্রদীপের বক্তব্য নিতে সিনহা থানায় গেলে তাকে সরাসরি হুমকি দেওয়া হয়।

সিনহা হত্যা ঘটনার পর তৎকালীন পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের একটি অডিও প্রকাশ পেয়েছিল। সে বিষয়ে তদন্তে কি মিলেছে এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আগ থেকেই ওসি প্রদীপ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছিল। তা নিয়ে এসপি মাসুদ খুবই উদাসীন ছিলেন। পাশাপাশি সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফাসহ স্থানীয়দের নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যম আসার পরেও পুলিশ সুপারের কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। এছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করে আহত মেজর সিনহার চিকিৎসা ব্যবস্থা না করাসহ বিভিন্ন বিষয় তদন্ত কর্মকর্তা আমলে এনেছেন। পুলিশ সুপারের অপেশাদার আচরণ এবং দায়িত্ব পালনে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার দরকার ছিল বলে মনে করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, সার্বিক ঘটনা বিবেচনায় একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে এসপি এবিএম মাসুদের পুরো ঘটনা তদারকিতে ঘাটতি ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদের গাঁ ছাড়া আচরণ এবং দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন।

সিনহা হত্যার সঙ্গে অন্য কোনো অপকর্ম বা অপরাধের সাদৃশ্য খোঁজা অমূলক। সেই রাতে সিনহার মাকেও ফোন করা হয়েছিল। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরও তাকে হত্যা করা হয়। ওসি প্রদীপ যা করেছেন তা খুবই ন্যাক্কারজনক কাজ বলে মন্তব্য করেন আশিক বিল্লাহ।

কী ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল মেজর সিনহাকে জানতে চাইলে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, মেজর সিনহাসহ তার দলকে ইউটিউব চ্যানেলের কাজ বাদ দিয়ে টেকনাফ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। নইলে তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হবে বলে সরাসরি হুমকি দেন ওসি প্রদীপ।

ডিজিটাল কনটেন্ট পাবার ক্ষেত্রে ল্যাপটপের ফরেনসিক টেস্ট করা হয়েছিল কী-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগেই ল্যাপটপের ডিজিটাল কনটেন্ট ডিলিট করা হয়েছে। সেগুলো না পেলেও সাক্ষ্য প্রমাণে ও জবানবন্দিতে এটা স্পষ্ট পরিকল্পিত হত্যা।

আপনার মতামত জানান