ইসলামের দৃষ্টিতে ছাত্রকে শিক্ষাদান
ইসলাম শিশুর লেখাপড়া ও চারিত্রিক উন্নয়নে তাকে শাসনের অনুমতি দিয়েছে। তবে শিশুদের শাসনের ব্যাপারে কঠোর শর্তারোপ করা হয়েছে। যার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছে না সাধারণ ও ইসলামী ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষক।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক : শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক পিতৃতুল্য। শিক্ষক পিতার মতো স্নেহ ও মমতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করবেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পিতার মতো, আমি তোমাদের শিক্ষা দিই। তোমাদের কেউ শৌচাগারে গেলে কিবলার দিকে মুখ করে বা পিঠ করে বসবে না, ডান হাত দিয়ে ইস্তিঞ্জা করবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৮)
শিক্ষার্থীর জীবন ও সময় আমানত : শিক্ষার্থীর জীবন ও সময় শিক্ষকের জন্য আমানত। সুতরাং শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনোন্নয়নে ও সময়ের যথাযথ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবে, শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়—এমন যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই (তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়ে) জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৮৮)
শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন শিক্ষকের দায়িত্ব : শিক্ষক শুধু পুঁথিগত বিদ্যা শেখালেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘শিক্ষার্থীর অধিকার হলো শিক্ষক শুধু আক্ষরিক পাঠদান করবে না; বরং শিক্ষার্থীর আমল ও স্বভাব-চরিত্রের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে, যেদিকে এখন খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লক্ষ্য রাখা হয়। শিক্ষকরা শুধু পাঠদানকে যথেষ্ট মনে করেন।’ (তাজদিদে তালিম ওয়া তাবলিগ, পৃষ্ঠা ১২৬)
শাসনের অর্থ শুধু প্রহার নয় : শিক্ষার্থীর ভেতর শিশুসুলভ দুষ্টুমি এবং পারিপার্শ্বিক কারণে নিয়মভঙ্গের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনের প্রয়োজনে শিশুকে শাসন করা যেতে পারে। তবে শাসনের অর্থ শুধু প্রহার নয়। ইসলামী আইনজ্ঞদের অভিমত হলো, ‘ছাত্রদের আদর-যত্নের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে পড়াশোনা ও সচ্চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করাই শিক্ষা ও দীক্ষার উত্তম পন্থা। এ ক্ষেত্রে সাজা দেওয়ার প্রয়োজন হলে প্রহার ছাড়া অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।’ (ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৭/৫০০)
প্রহারসংক্রান্ত হাদিস ও তার ব্যাখ্যা : সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য ইসলাম অভিভাবককে শিশুদের মৃদু প্রহারের অনুমতি দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাত বছর বয়সে উপনীত হলে তোমরা তোমাদের সন্তানদের নামাজের নির্দেশ দাও এবং তাদের বয়স ১০ বছর হলে তাদের নামাজের জন্য প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)
উল্লিখিত হাদিসের আলোকে ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেন, শিশুর চরিত্র গঠনের জন্য অভিভাবকের জন্য এবং অভিভাবকের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষকের জন্য মৃদু প্রহার করা বৈধ। তবে তারা কিছু শর্তারোপ করেন। তাহলো—
১. সাত বছর বয়স তথা শাসন বোঝার মতো বয়স হওয়ার আগে শিশুর সঙ্গে সব ধরনের কঠোর ব্যবহার পরিহার করতে হবে।
২. শিশুর বয়স ১০ অতিক্রম করলে নামাজ ছেড়ে দেওয়ার মতো অন্যায় করলে তাকে শাসন করা যাবে।
৩. হাত দ্বারা শাস্তি দেওয়া, লাঠি, বেত ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দেওয়া যাবে না। কেননা বেতের ব্যবহার ইসলামী শরিয়ত হদ-তাজির বাস্তবায়নের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
৪. একবারে তিনের বেশি প্রহার না করা। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি তিনের বেশি আঘাত করা থেকে বিরত থাকো। তুমি যদি তিনের বেশি প্রহার করো, তবে আল্লাহ তোমার কাছ থেকে হিসাব নেবেন।’ (তাজরিদু আসমায়িস-সাহাবাতি : ২/৬৯)
৫. শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলো, যেমন—মাথা, চেহারা ইত্যাদিতে শাস্তি না দেওয়া।
৬. শরীরে ক্ষত বা দাগ পড়া কিংবা হাড়ে আঘাত লাগার মতো শাস্তি না দেওয়া।
উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীর অভিভাবক অথবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো শিক্ষার্থীকে প্রহার করতে নিষেধ করা হলে উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষেও প্রহার করার অনুমতি নেই। (বিস্তারিত দেখুন : ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৭/৫০১)
মাদরাসা শিক্ষকদের প্রতি পরামর্শ : আল্লামা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.) শর্তসাপেক্ষে সাবালক শিক্ষার্থীকে প্রহারের অনুমতি শরিয়তে রয়েছে উল্লেখ করার পর বলেন, ‘কিন্তু বর্তমানে সাধারণ মানুষের ভেতর আগের মতো দ্বিনি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ নেই। এ জন্য বেশির ভাগ অভিভাবক শিক্ষকের শাস্তি প্রদান পছন্দ করেন না। এ ছাড়া বর্তমানের শিক্ষকরাও শরিয়তের বিধি-বিধান জানা ও চারিত্রিক উৎকর্ষে পিছিয়ে। ফলে তাঁরা শরিয়তের সীমার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন না। এ জন্য শিক্ষার্থীকে প্রহার করা যাবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে, শিক্ষক শিশুর লেখাপড়ায় অমনোযোগ ও ত্রুটির বিষয়ে তার মা-বাবাকে অবগত করবেন। বলবেন, এই শিশু ঠিকমতো লেখাপড়া করছে না। এখন মা-বাবা চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন অথবা দেবেন না।’ (ইমদাদুল আহকাম : ৪/১৩৪)
শিক্ষকের চারিত্রিক উন্নতি অপরিহার্য : আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) মাদরাসা শিক্ষকদের নৈতিক উন্নয়ন ও আল্লাহভীতি অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন, যেন তাদের থেকে অনৈতিক ও অন্যায় আচরণ প্রকাশ না পায় এবং শিক্ষার্থীরা প্রকৃত দ্বিনি জ্ঞান ও বোধ অর্জন করতে পারে। তিনি বলেন, ‘জ্ঞানের একটি প্রকৃত রূপ হলো ইসলামের বিধি-বিধানগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারা। আর আমি কসম করে বলছি, তা আল্লাহভীতি ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। যদি দুই ব্যক্তি একই বয়সের হয় এবং তারা একজন শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করে, আর তাদের মেধা-যোগ্যতাও সমান হয়; কিন্তু তাদের একজন আল্লাহভীরু এবং অন্যজন আল্লাহভীরু নয়। তবে অবশ্যই আল্লাহভীরু ব্যক্তির জ্ঞানে বরকত ও নূর হবে এবং সে সঠিক বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হবে। তার থেকে যারা দ্বিনি শিক্ষা অর্জন করবে তারাও বেশি উপকৃত হবে।’ (আল-ইলমু ওয়াল উলামা, পৃষ্ঠা ২১১)
কঠোরতা নবীজির আদর্শ নয় : ইসলামী শরিয়তে শিক্ষার্থীকে সামান্য শাসনের অনুমতি দিলেও নিঃসন্দেহে তা মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত পথ ছিল না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো তার কোনো সেবক বা কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৬)
শিক্ষার্থীর সঙ্গে কঠোর আচরণের কুফল : আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) বলেন, ‘সেবক ও শিক্ষকদের মধ্যে কঠোরভাবে লালন-পালন করলে ছাত্রদের মনও কঠোর ও রূঢ় হয়ে পড়ে। অতঃপর অলসতা ও মিথ্যা বলার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এমনিভাবে প্রাথমিক অবস্থায় কঠোরতা ও রূঢ়তার ফলে ধীরে ধীরে একটি জাতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।’ (আল মুকাদ্দিমা, অধ্যায় : শিক্ষার্থীদের প্রতি কঠোরতা ক্ষতি, পৃষ্ঠা ৭৪৩)
আল্লাহ সবাইকে শিশুর প্রতি কোমল আচরণ করার তাওফিক দিন। আমিন।
আপনার মতামত জানান