ইতিকাফে ইবাদতের অবারিত সুযোগ মেলে

প্রকাশিত

রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ নবীজীবনের ধারাবাহিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের সুযোগ, আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য লাভসহ বহুবিধ কল্যাণের সর্বোত্তম ইবাদত এই ইতিকাফ। তাইতো রাসুল (সা.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

নিম্নে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের কয়েকটি উপকারিতা তুলে ধরা হলো।

আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন : আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন মুমিনজীবনের চরম প্রত্যাশিত বস্তু। কারণ আল্লাহর ভালোবাসা ছাড়া মুমিনের কোনো সফলতা নেই। আর ভালোবাসা তৈরির বড় একটি মাধ্যম হচ্ছে ইতিকাফ। যারা আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করবে, দুনিয়া-আখিরাতে তাদের কোনো ভয়ভীতি নেই।

ইরশাদ হয়েছে, ‘মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনো ভয়ভীতি নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হলো মহাসফলতা।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৬২-৬৪)

মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি : দুনিয়ায় মহান আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা মসজিদ। মুমিনের জন্য এটি আত্মিক প্রশান্তি লাভ, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও ঈমান-আমল উন্নত করার সর্বোত্তম জায়গা। আর ইতিকাফকারীরা পুরো সময় আল্লাহর ঘর মসজিদেই সময় কাটায় এবং মসজিদের সঙ্গেই ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ডেকে ডেকে বলবেন, আমার প্রতিবেশীরা কোথায়? আমার প্রতিবেশীরা কোথায়? তখন ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করবেন, আপনার প্রতিবেশী কারা? তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, যারা দুনিয়ায় আমার ঘরের সঙ্গে (মসজিদের সঙ্গে) সম্পর্ক রেখেছে এবং মসজিদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে।’ (হিলয়াতুল আউলিয়া : ১০/২১৩)

সময়ের হেফাজত : মুমিনজীবনের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের প্রতি যত্নশীল হলেই জীবনে সফলতা আসে। আর ইতিকাফের মাধ্যমে একজন মুমিন কিভাবে সময়ের হেফাজত করবে তার যথাযথ ধারণা সে এখান থেকে গ্রহণ করতে পারে। সময়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সময়ের (মহাকাল) শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা : আসর, আয়াত : ১)

আর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, যে দুটিতে বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর।’(বুখারি, হাদিস : ৬৪১২)

গুনাহ থেকে বাঁচা : একজন মুমিন বান্দা সব সময় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। তবে অনেক সময় পাপের অনুকূল পরিবেশ, অসৎসঙ্গের প্রভাব ও শয়তানের সার্বক্ষণিক প্ররোচনায় গুনাহমুক্ত থাকা সম্ভব হয় না।

কিন্তু ইতিকাফের সময়গুলোতে সৎসঙ্গ ও ইবাদতের পরিবেশ থাকায় খুব সহজেই সে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে। এক বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেজগার লোকে খায়।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৩২)

অধিক ইবাদতের সুযোগ : ইতিকাফের বড় একটি উপকারিতা হচ্ছে, অধিক ইবাদতের সুযোগ পাওয়া। এ জন্যই আল্লাহর রাসুল (সা.) ইতিকাফের সময়গুলোতে ইবাদতের মাত্রা এত বেশি বাড়িয়ে দিতেন, যেমনটি অন্য সময় করতেন না। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন রমজানের শেষ ১০ রাত আসত, তখন নবী করিম (সা.) কোমরে কাপড় বেঁধে নেমে পড়তেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন। আর পরিবার-পরিজনকেও তিনি জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১০৫৩)

লাইলাতুল কদর লাভের সুযোগ : রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের বড় একটি উপকারিতা হচ্ছে লাইলাতুল কদর লাভের সুযোগ পাওয়া। আর লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে (লাইলাতুল কদর)।

আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা এবং রুহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৫)

হাদিস শরিফের বিভিন্ন ভাষা দ্বারা বোঝা যায়, উল্লিখিত আয়াতে মহিমান্বিত যে রাতের কথা বলা হয়েছে, তা এই শেষ দশকেই লুকিয়ে আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৭)

সুন্নত আদায় : রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সপরিবারে প্রতিবছরই ইতিকাফ করেছেন এবং উম্মতকেও এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন।

একবার সাহাবাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে।’ এরপর মানুষ তাঁর সঙ্গে ইতিকাফে শরিক হয়। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৯৪)

অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা : ইতিকাফের বড় একটি উপকারিতা হচ্ছে অনর্থক কথা-কাজকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখা। কারণ অনর্থক কথা-কাজ মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৮)

মহান আল্লাহ আমাদের ইতিকাফের সব কল্যাণ দান করুন।

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ

আপনার মতামত জানান