তালগাছ আমাদের সুহৃদ বন্ধু

প্রকাশিত



গ্রামীণ প্রকৃতির সবুজশ্যামলীমার অবিচ্ছেদ্য অংশ তাল গাছ। গ্রামীন দৃশ্যে তালগাছ না থাকলে কেমন যেন অসম্পন্ন মনে হয়। খাঁন মুহাম্মদ মঈন তার কবিতায় তালগাছকে কেন্দ্র করে গ্রামীন প্রকৃতিকে বিশ^ময় করে তুলেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্যে কবিগুরু লিখেছেন তাল গাছের বিশালতার কথা। তাল গাছ শুধু প্রকৃতিকে সাজিয়ে ক্ষান্ত হয়নি দুর্বিপাক থেকে প্রকৃতিকে বাঁচাতে, মানুষের জীবনমান উন্নয়ণ এবং রয়েছে বহুমাত্রিক ওষুধীগুণ। বর্তমানে তাল শাঁসের চাহিদা তালগাছের বানিজ্যিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। তীব্র দাবদাহে একটু স্বস্তি পেতে বাংলাদেশের অপ্রচলিত রসালো ফলের স্বাদ নিচ্ছেন অনেকে। রাস্তার পাশে ফুটপাতে বিক্রি হওয়া কচি তালের শাঁস বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এ ফলের স্বাদ নিতে ছুটে আসছে শহর গ্রাম থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক ও স্থানীয়রা। চাহিদা বেশি থাকায় ক্রেতাদের সামাল দিতে ব্যবসায়ীদের হিমশিম খেতে হয়।

শাখা প্রশাখা বিহীন একবীজপত্রী উদ্ভিদ তালগাছ বিস্তৃতি সারা বাংলায়। একক লম্বা কাণ্ড ও তার আগায় সুন্দরভাবে এক গুচ্ছ পাতার সমারোহে সুশোভিত তাল গাছ দেখতে অপূর্ব লাগে। তালগাছ পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ যা উচ্চতায় ৮০ ফুট ছাড়িয়ে যায়। তালের পাতা পাখার মতো ছড়ানো তাই বোরোসাস গনের পাম গোত্রীয় গাছ গুলিকে একত্রে ফ্যান-পাম বলা হয়। এ উদ্ভিদ এক দল বীজ পত্র দলীয় এবং এ গাছের শিকড় গুচ্ছ মূল বিশিষ্ট। তাল গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে পৌঁছে না তবে শতাধিক গুচ্ছ মূল চারদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। যুগযুগান্তর ধরে তালগাছের বহুমাত্রিক গুণ প্রমানিত হয়েছে। গরমের দিনে গাম ঝড়ানো সন্ধ্যায় মিষ্টি তালের রস মূহুর্তেই এনে দেয় প্রশান্তি। জানা যায়, একটি তালগাছ থেকে সকাল দুপুর ও বিকেল তিনবেলা তালের রস পাওয়া যায়। গাছিরা তালের রস বিক্রির পাশাপাশি তৈরি করেন তালের পাঠালি গুড়। তালমিশ্রি কফ ও কাশির মহা ওষুধ হিসিবে ব্যবহার হয়। বৈশাখ, জ্যোষ্ঠ মাসের লেপা বা সুস্বাদু তালশাঁস ছোট বড় সবার খুব প্রিয়। শ্রাবনের শেষের দিকে পাকা গন্ধ ছড়ায় গ্রামীন বাতাসে। ভাদ্র মাসে তালের পিঠার খাওয়ার হিরিক পড়ে। গ্রামে অনেকে বলেন তাল খেলে কাল যায়। তাই তালের পিঠা খেতে আত্মীয় বাড়িতে মেহমানের আনাগোনা লেগে যায়। তালের পিঠায় জমে ওঠে জামাই আদর। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ তালের পিঠা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। তালের আটি পিষে রস বের করে ফেলে দেয়ার পর আবার আটি থেকে অঙ্কুর বের হলে সেই আটি কেটে ভিতরের স্বাস খেতেও অনেক মজা।
তালপাতা দিয়ে গ্রামের গরিব মানুষেরা ঘর তৈরি করে। তালের পাতার উপর দিযে হাটলে কিংবা ভারি কিছু পড়লে অনেক জোড়ে শব্দ হয়। তাই অনেকে বাড়ির সীমানা বেড়া এবং ধানের গোলায় চারিদিকে তালের পাতা বিছিয়ে রাখে যাতে বাড়িতে চোর আসতে না পার। তালের পাতার তৈরি হাতপাখার বাতাসে কৃষাণ-কৃষানির ভালবাসার রসায়ন বহুগনে বাড়িয়ে দেয়। তালপাতার চাটাই, মাদুর গ্রামে অতি পরিচিত। আঁকবার পট, কুন্ডলী, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি করা হয়। তালের কান্ড দিয়ে বাড়ি, ধান ক্ষেতে পানি দেয়ার খুচি (সরলযন্ত্র), নৌকা, ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

তালপাতা দিয়ে তৈরি বাঁশি গ্রামীণ মেলার প্রধান আর্কষন ছিলো। আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশী কিনে এনেছি- প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে তো তালপাতার বাঁশি নিয়ে মোহনীয় সুরে মাতোয়ারা সবাই। বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা তালগাছে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। উঁচু হওয়ায় চিলসহ অন্যান্য পাখি বাসা বাঁধে তালের শাখায়। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা (ঝড়, সাইক্লোন) থেকে গাছকে রক্ষা ও ভূমির ক্ষয় রোধ করে। বয়স্ক গাছ ৬০-৮০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের আগায় ৩৫-৫০টা শক্ত পাতা থাকে। পাতার আগা সূচালো হওয়ায় বজ্রপাত রোধক গাছ হিসেবে এ ফলের আবাদ অতি জনপ্রিয়। একই কারণে বজ্রপাতের কবল থেকে প্রাণিকুলকে রক্ষা করার জন্য ও গাছের বহুবিধ ব্যবহার সুবিধাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে তাল ফল সম্প্রসারণে অনেক দেশেই প্রাধান্য দেয়া হয়।

কাগজ আবিস্কারের পূর্বে কয়েক শতক পর্যন্ত তালপাতাই ছিল সর্বাধিক ব্যবহৃত লিখন উপকরণ। দ্বিতীয় শতকে প্রাপ্ত মধ্য এশিয়ায় তুরফান অঞ্চলের ভারতীয় নাটকের একখন্ড তালপাতার পান্ডুলিপিকে সর্বাধিক প্রাচীন তালপাতার পান্ডুলিপি মনে করা হয়। তালপাতা সংরক্ষণ করছে পূর্বভারতের হাজার বছর আগের জীবন যাত্রা। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার গ্রন্থাগারে তালপাতার লেখা চর্যাপদ আবিস্কার করেন। তালপাতায় লেখা চর্যাপদই হয়ে ওঠে বাংলাসহ পূর্বভারতের অন্যান্য অঞ্চলের আরাধ্য ও সাধন গ্রন্থ।

সরেজমিনে দেখা যায়, সোনারগাঁ পৌরসভা সহ উপজেলার ১০ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন অলিগলিতে, রাস্তার পাশে শতাধিক স্থানে তালের শাঁস বিক্রি হচ্ছে। প্রত্যেক দোকানে গড়ে ৪ শত তাল বিক্রি হচ্ছে। ছোট-বড় সব বয়সের মানুষের পছন্দের খাবার হিসেবে সমাদৃত তালের শাঁস। বিশেষ করে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা, মোগরাপাড় বাজার, বৈদ্যের বাজার, আনন্দবাজার, সোনারগাঁ উপজেলা গেইট, বারদী বাজার, শান্তির বাজার, মহজমপুর বাজার, নয়াপুর বাজার, জামপুর ও কাঁচপুর বাজারে তালের শাঁস প্রচুর বিক্রি হচ্ছে।
সোনারগাঁ উপজেলার বটতলায় দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর ধরে তাল শাঁস বিক্রি করছেন বারেক বেপারি। তিনি জানান, আগে মানুষ এত পরিমান তাল শাঁস খেত না। বর্তমানে প্রচন্ড গরম এবং তাল শাঁসের উপকারিতা জানতে পারায় বিক্রি অনেক বেশি হয়। তিনি জানান, তাল শাঁস বিক্রির প্রক্রিয়াটি জটিল। তাল কেটে শাঁস বের করে আনা খুবই কঠিন কাজ। এক হাতের উপর তাল রেখে আরেক হাতে ধারালো দা দিয়ে তাল কেটে শাঁস বের কথা খুবই ঝুঁকির কাজ। তাল কাটতে গিয়ে কতবার হাত কেটেছি এর ইয়াত্তা নেই। তাল শাঁসের ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকের অঙ্গহানিও হয়েছে। তিনি আরো জানান, সোনারগাঁয়ের তাল ১ থেকে দেড় মাস পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
তাল শাঁস ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, এটি একটি ক্ষণস্থায়ী সিজেনাল ব্যবসা। একমাস কোন রকমে এ ব্যবসা করা যায়। তবে লাভ যেমন বেশি পরিশ্রমও কিন্তু কম না।

চৌরাস্তার ব্যবসায়ী হোসেন মিয়া জানান, তাল শাঁস বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা খুবই কষ্টের। গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় গাছ থেকে তাল নামিয়ে আনতে গাছিদের ৭ শ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। তারা তাল নামিয়ে আনলে আমাদের কাজ শুরু। সারাদিন তাল কাটতে কাটতে দুই হাত সহ সারা শরিরে ব্যথা হয়ে যায়। তিনি জানান, প্রতিটি তালের শাঁস দশ টাকায় বিক্রি করেন। আকার বেদে ২০ টাকা আবার পাঁচ টাকাও বিক্রি করেন। গাছে প্রতিটি তালের ক্রয়মূল্য পড়ে ২ থেকে ৩ টাকা। প্রতিটি তাল থেকে তিনটি করে শাঁস পাওয়া যায়। গড়ে প্রতিটি তাল ২৪ টাকায় বিক্রি করা যায়।

তাল গাছের মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারের প্রচার প্রচারনা দেখে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা তাল গাছ রোপন করেছি। কাঁচা তাল বিক্রির পরে যেগুলো থাকে সেগুলে পাঁকলেও ভাল দাম পাওয়া যায়। তবে কাঁচা তালে খুব একটা দাম পাওয়া যায় না। তারা জানান, তালগাছ রোপনে সোনারগাঁ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের কোন উদ্যোগ না থাকায় সোনারগাঁয়ে তাল গাছের সংখ্যা খুব একটা বাড়ছে না।

তাল শাঁস ও তালের রস ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন বলেন, তাল গাছের মধ্যেও পুরুষ মহিলা আছে। পুরুষ গাছ থেকে আমরা রস সংগ্রহ করি আর মহিলা তাল গাছ তাল। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে গাছের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

সোনারগাঁ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, সোনারগাঁয়ে কতগুলো তালগাছ আছে এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তাছাড়া কত টাকার তাল শাঁস বিক্রি হচ্ছে তাও বলতে পারবনা। আমি জেলা অফিসে প্রস্তাব রেখেছি, সোনারগাঁয়ের যে কোন একটি রাস্তা পুরো তালগাছ রোপন করার।

আপনার মতামত জানান